In Love with Forest

********* হে অরণ্য **********
দীপঙ্কর রায়
________________________________________

আধো ঘুমচোখেই নবকিশোরের বোলেরো তে সওয়ারী হলাম। ভোরের আলো সদ্য ফুটতে শুরু করবে। বলে দিলাম ঘন্টাদেড়েক পরে চা এর জন্য দাঁড়াতে। সাবজী চায়ে এ পিনা হ্যয় ,,, উঠিয়ে জী- চোখ খুলতে দেখি নবকিশোরদা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। জানালার কাঁচ নামিয়ে কাঁচের গ্লাসের ধোঁয়া ওঠা চা এ চুমুক দিয়েই ধাতস্হ হলাম। এখনো অনেকটা পথ বাকী। আকাশ মেঘলা। কোথাও কোথাও অল্প বৃষ্টি হয়েছে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর মূল শহরে প্রবেশের করলাম। । ভারত সরকারের ন্যালকো কোম্পানীর কাজকম্র কিছু চোখে পড়ল। আজকাল জঙ্গল লাগোয়া এই মাইনিং এর কাজকম্র বেশ জোরের সাথে চলছে। আদিবাসীদের জমি কেড়ে, জঙ্গল সাফ করে এই উন্নয়নের পোশাকি নাম হল নগরান্নোয়ন। বন দপ্তরে গিয়ে বাংলো বুকিং এর অনুমতি নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম। বন বাংলোগুলোর বুকিং এর দায়িত্বে যারা থাকেন তারা নিজেদের এমনভাবে রিপ্রেজেন্ট করেন মনে হয় ঈশ্বর একমাত্র এদের ওপরে। পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে গাড়ী মোরাম রাস্তায় পড়বার সাথে সাথে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করল। দু পাশে ছোটো ছোটো পাহাড়ী টিলা আর খন্ড খন্ড আদিবাসী গ্রাম পেরিয়ে গাড়ী চলছে। নবকিশোরদাকে বললাম এ রাস্তায় আগে এসেছ ? বললো না আসেনি। ভাবছি কাকে আর জিজ্ঞাসা করবে?? কাউকেই দেখতে পাছ্ছে না। কিছুটা যাবার পর গাড়ীর আগে দেখলাম সাইকেল জাতীয় চাকার দাগ স্পষ্ট। একসময় দাগটা মিলিযয়ে গেল। এইবার পুরো ঘন জঙ্গলের রাস্তায়। মোবাইল থাকলেও অ্যন্টেনা অকেজো। এই সময় হূসষ্ হূসষ্ হূসষ্ আওয়াজ করে বোলেরো থেমে গেল । টায়ার পাংচার। বাঁদিকের দরজা খুলে নামতে যাব বনেট এর ওপর জোর আওয়াজ,,,চিতাবাঘ লাফিয়ে মূহূতের মধ্যে জঙ্গলে। এই সময় আকাশ কালো করে এল। চিতাবাঘ না পাম্ সিভেট --- ভাবতে ভাবতেই কিশোরজী বললো স্যর টায়ার তো মেরা পাস নেহী হ্যায়; -- বুঝলাম বিপদ সামনে দাড়িয়ে।
________________________________________

স্নান হয়নি, বেলা যে খুব হবে তাও বোধহয় নয়, মেঘ থাকলেও ভ্যপ্সা গরম। বাংলোর পারমিশন করানোর ফাঁকে এক কাপ চা আর পোড়াপিঠে খেয়েছি। নবদা প্রয়জোনীয় রেশন আগেই নিয়ে নিয়েছিল । কিনে আনা কোল্ড ড্রিংক থেকে দুটো চুমুক দিলাম, ইতি উতি থাকালাম। নবদা চাকা খুলছে, রেগে গিয়ে বললাম খুলে আর কি হবে? গাড়ী কো স্ক্র্যপ সমজ কর বেচ দো : এ ঠিক নেহী ও ঠিক নেহী ,, ঘাটিঁয়া গাড়ী হ্যায় ইয়ে,- বলেই নিজের ই খারাপ লাগলো, বয়স্ক মানুষ, গাড়ী চালানোর হাত অসাধারণ।এর আগেরবার এই জঙ্গলের অন্য দিকে নিয়ে গিয়ে অনেক কিছুই আমায় চিনিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি জঙ্গলকে ভালোবেসে যে সব মানুষ দিন গুজরাণ করেন, তাদের অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে চললে প্রাপ্তি বেশী। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এরকম বহু মানুয বিভিন্ন ভাবে আমায় সমৃধ্ব করেছেন। কোল্ড ড্রিংক এর বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললাম সরি। দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। যেখানে গাড়ীটা খারাপ হল তার দুপাশে ঘন জঙ্গল আর ওই জঙ্গল পথের ফাঁক দিয়ে একটা সবুজ মাঠ ও অনুচ্চ টিলা। মাঠ পেরিয়ে টিলার ওপর উঠে সিগন্যাল ট্রাই করব কিনা ভাবছি, অন্য জন্তুদের এত ভয় না পেলেও জংলী হাতিকে সমীহ করে চলাই জঙ্গলের অলিখিত দস্তুর। বুদ্দি করে নবদা গাড়ীতে রাখা কিছুটা কেরোসিন খালি জলের বোতলে ঢেলে , গাড়ীর মোছার কাপড় , আর একটা শক্ত মোটা গাছের ডাল নিয়ে নিল। একটু অবাক হলাম, চোখের দিকে থাকাতেই ভরসাপূণ চাওনি পেলাম। দুজনে কঞ্চি; বাঁশ, ঝোপঝাড়, ডালপালা সরিয়ে মাঠে এলাম। পা দিয়ে বুঝলাম হাঁটু অবধি না হলেও বেশ বড় ঘাস। ঘাস এর ওপর দিয়ে সন্তপণে হেঁটে এলাম টিলার ওপর যদি সিগন্যাল পাওয়া যায়। কিন্তু বিধি বাম। হঠাথ

নবদার মোবাইলে পিং পিং আওয়াজ, ধূস টাওয়ার নেই , গান ডাউনলোড এর মেসেজ। মেজাজ ঠিক রাখা দায়। এই সময় আমি নবদার ফোনটা নিয়ে ওর মালিক কে লিখলাম - টায়ার পাংচার সেন্ড কার সুন, নো টায়ার ইন কার। প্রায় পাঁচবারের চেষ্টায় মেসেজ গেল। হঠাত পেছন ফিরে দেখি নবদা বলছে - স্যার ম্যায় বরবাদ হো যাউঙ্গা ,,,, ও দেখিয়ে গাড়ী কা পাশ, টিলা থেকে গাড়ীর দিকে থাকাতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
________________________________________

হাতের ইশারায় নবকিশোরদা কে চুপ করতে বলে সোজা গাড়ীর দিকে তাকিয়ে আছি । গাড়ীর দিকে তীক্ন নজর রেখে উপস্হিত বুধ্ধির উপর ভরসা রেখে এগোতে হবে। সদ্য অভয়ারণ্যে থেকে ব্যাঘ্র প্রকল্পের তক্মা পাওয়া একবারে আনকোরা এই জঙ্গল। নবদার গায়ের হালকা উজ্জ্বল গোলাপী রঙের টি শার্টটা খুলতে বললাম। গাড়ীর দিকে তাকিয়ে ঠিক বুজতে পারছি না মা একাই না বাচ্চা আছে ? থাকলেও কতজন ? নবদার কথায় একটাই বাচ্চা। আমি বাচ্চা টাকে দেখতে পেলেও মা কে দেখতে পাছ্ছি না। বাচ্চাটার আশেপাশে যে বন্যপ্রাণী ঘোরাফেরা করছে তার একটা পদখেপ ই বাচ্চাটার জীবন সংশয় হতে পারে। যে কোনো অরণ্যচারীর কাছে এই দৃশ্য কল্পনাতীত। নবদার চিন্তা গাড়ীর বনেট আর তার ভেতর ইন্জিন। আমার চিন্তা শাবক আর গাড়ীর ভেতর এ থাকা ক্যামেরা আর লেন্স। বেশী নাড়াচাড়া করলে লেন্স এর ব্যাগ পরে যদি ভেঙে যায়। নিজের ওপর রাগ হছে কেনো ক্যামেরার ব্যাগ সাথে নেইনি। প্রাণে চাইছি একটা জোর বৃষ্টি। নবদা কাপড়ে কেরোসিন লাগাবার তোড়জোড় শুরু করতেই বারণ করলাম। জঙ্গলের যেমন নিজস্ব ছন্দ আছে বন্যপ্রাণীদের আছে একধরনের "বিহেভীয়ার" যেটা বোঝা একজন জঙ্গল প্রেমীর মানুষের খুব দরকার। বিপদে এই বিহেভীয়ার থার্ড আই এর কাজ করে। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে নজরমিনার উঠে ঔই বাইসন বাইসন বলে চীতকার করলেই বা আমরা ঔই দেখেছি,দিদি আপনি দেখেন নাই ? কিছু না পেলে বেকার পয়সা দিলাম ফালতু এই মানসিকতা না ছাড়লে জঙ্গল বোঝা যায় না। ডুর্য়াস এর জঙ্গলের নজরমিনার গুলোতে বাজার বসে যায় এখন হয়ত চেঞ্জ হলে হতে পারে। এই সময় গাড়ী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওপরে তাকাতেই ভয় আর আতঙ্ক সরে গিয়ে খুশী , উত্তেজনা আর টেনসন ----- শাবকের মা আই লেবেলে।
________________________________________

মা এর উপস্হিতি টের পেয়ে লের্পাডের বাচ্চাটা বনেটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক একবার মেপে নিল। দাঁতাল হাতিটা বুজতে পারছে না কি করা উচিত। সে এতখন পাহারা দিছছিল। আমার কাছে লের্পাডের বাচ্চার সাথে দাঁতালের এই মেলবন্ধন ছিল এক বারে অপ্র্ত্যাশিত। বুজতে পারছিলাম না যে মা লের্পাড টা গাছ থেকে কি ঔই দাঁতাল এর জন্য নামতে অপারগ ছিল না শাবক কে পরিস্তিতির সাথে জুঝে নেবার সুযোগ???আবার দাঁতাল ও গাড়ীর দিকে এগোছ্ছে না যদিও গাড়ীতে যথেস্ট খাবার ছিল । মনের মধ্যৈই প্রশ্ন গুলো নিজেকে পাজ্ল করছিল ??? ঝির ঝির বৃষ্টি টা একটু গতি নিতেই মা লের্পাড গাছ থেকে এসে বাচাটাকে নিয়ে আমার দৃষ্টির বাইরে। নবকিশোরদাকে বললাম লের্পাড তখনই বাচ্চা নিয়ে ক্রস করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমরা এসে পড়ায় আর পারেনি। নবদা বলল তা ঠিক লেকিন টাস্কার কা কেয়া হোগা??? সাধারণতঃ যে অরণ্যগুলোতে লোকজন কম যায় সেখানখার বন্যপ্রাণীদের মতিগতি বোঝা দায়। নবদাকে বললাম আগুন জ্বালাতে হতে পারে। দাঁতালটা বোলেরো সামনে । গাড়ীর ভেতর এর জিনিসগুলো তার দরকার। বহূদৃর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। আগুন জ্বালিয়ে যে এগোবো সেটাও হবে না কারণ এটা জংলী হাতি তারওপর দাঁতাল। এই সময় দূর থেকে আসা আওয়াজ টা বেশ তীব্র হল। দাঁতাল টা সেই আওয়াজের দিকে পা বাড়াতে লাগল। দেখলাম বেআইনী কাঠবোঝাই লরি। দাঁতাল লরিটার পথ আটকে। আমার গাড়ী থেকে 250 মিটার। খুব খিদে পেয়েছ , পিপাসাও , জামাকাপড় ভেজা তবু টিলা ছেড়ে উঠতে ইছ্ছে করছেনা।খুব জোড়ে শ্বাস নিলাম আমি। অনেকদিন পর আনকোরা জঙ্গলের ঘাস এ পা দিয়েছি।

মনে সাহস আর চাঁপা টেনসন নিয়ে গাড়ীর দিকে অগ্রসর হলাম। বর্ষা পরবর্তী পথের ধার ও ওপর ঝোপঝাড়ের বংশবৃদ্বি।চোরাই লরিকে জিজ্ঞাসা করলাম বাংলো কি ধার হ্যায়?? এ রাস্তা নেহী ।।।আপকো ছয় কিমি ঘুমকে জানা হ্যায়। এ রোড সে জানাসে 2 কিমি , লেকিন রাস্তা বন্ধ,, পেড় সে বন্ধ হ্যায় । নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল "-----মেরেছে - এবার কি করব? " দাঁতাল তখন ও লরির সামনে।
________________________________________

একটু খিদে পেয়েছিল। গাড়ীতে রাখা জলের বোতল বের করে ছাতু গুলে নিলাম। ছাতু,গ্লুকোজ,টর্চ, মোমবাতি আর শুকনো খাবার এগুলো জঙ্গল ভ্রমণের সময় রাখবেন বিশেষ করে ছাতু। এক ঢোঁক করে গলাধ:করণ করছি আর চোখ ঐ বেআইনি লরীর কাছে। দাঁতাল একাই আটকে রেখেছে । লরীর ড্রাইভার বিকট স্বরে ইন্জিন চালু করতেই সে এগিয়ে যাছ্ছে চার্জ এর মোডে। ড্রাইভারকে ইশারায় এন্জিন বন্ধ করতে বললাম। নবকিশোর তার মাতৃভাষায় কি সবওই লরীর ড্রাইভারকে বলল। তাতে ড্রাইভারের কতটা বোধদয় হল বলতে পারব না,তবে সে গাড়ীটা পিছিয়ে দাঁতালের আড়ালে নিয়ে গেল। নবদার মেজাজ খারাপ। দাঁতাল বনেটে দাঁতের চিঞ রেখেছে। তোবড়ানো বনেটের দিকে এক ঝলক দিয়েই দেখি গোঁ গোঁ শব্দ করে একটা মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়াল। বুঝলাম আমার রেসকিউ ভ্যান। রেসকিউ গাড়ীর চালক কেনো এক্সট্রা টায়ার গাড়ীতে রাখেনি কেনো তার জন্য নবদাকে তার মাতৃভাষায় পুনঃজন্ম করিয়ে ছাড়ল। আমি ও দু একটা নতুন শব্দ শিখলাম, হাতিটাও যে দু একটা শুনেছে তা বুজলাম হঠাৎ দেখি তার অভিমুখ আমাদের দিকে।
মেঘের আড়ালে অস্তগামী সূর্য, ঘরে ফেরা বিভিন্ন পাখির ডাকের মাঝে চাপা টেনশন যে এতটা পথ আবার ঘুরব । এই সময় একজন আমার মত লম্বা; হাফপ্যানট পরিহিত খাঁকি পোশাক পরিহিত লোক উদয় হল। কাঁধে কুড়ল জাতীয় জিনিস। দাঁতাল দেখেও ভাবলেশহীন। দেখেই মনে হল এই জঙ্গলটা হাতের তালুর মত চেনে।
________________________________________
নবকিশোর কিছু বলার পর আগন্তুক আমাকে দেখে সেলাম টুকলো। এ সেলাম এ ভয় না প্রীতি লুকিয়ে আছে সেটা বোঝা দুস্কর, জঙ্গলের এই সাধারণ মানুষরা আমাদের বিশ্বাস করে না কারণ এদের আমরা চিরকাল "এক্সপ্লয়েট" করে এসেছি। বাতচিত এ যা বুঝলাম গাড়ী নিয়ে এ পথ দিয়ে বনবাংলো পৌঁছানো যাবে না। তবে কিছুটা হেঁটে গেলে বাংলো কাছেই। নবকিশোর বলল ওর নাম সুভাষ। এখান থেকে তিন চার কিমি দূরে আদিবাসী বস্তীতে থাকে। বস্তীর গোরু মহিষগুলোকে জঙ্গলে নিয়ে আসে টিলার মত উচুঁ জায়গা থেকে ছেদন করা লগ গুলোকে নামিয়ে নিয়ে আসবার জন্য। কাজ সমাধা হবার পর আবার গবাদিগুলোকে নিয়ে ফিরে আসে। শৈশব থেকে এই জঙ্গল ওর জীবনধারণের মাধ্যম। ।সুভাষের শৈশব, কৈশোর,যৌবন এমনকি বার্ধক্য অবধি এই জঙ্গলে। সুভাষ দেখে ঈর্ষা হল, ভাবলাম আমিও যদি এই জীবনটা পেতাম। আমাদের এই মানবজাতীর সঙ্গে অরণ্যের একটাই বৈপরীত্য, আমাদের রোগ, জরা,মৃত্যু আছে, অরণ্যের নেই। তবে আজ তথাকথিত উন্নয়ন এর জন্য কিছু জঙ্গল হয় নিশিচ্ঞ না হয় মৃতপ্রায়। আমার কাছে প্রতিটি অরণ্য যেগুলোতে আমি নিয়মিত যাই প্রত্যক বার নতুনভাবে আর্ভিভূত হয়।
নতুন গাছপালা, ফুল , প্রজাপতি, জীবজন্তু সব কিছু ।সব সময় সে বার্ধক্যহীন। আর আমরা বসের টর্গেট পূরণ করতে করতেই জরাগ্রস্ত হই। ঐই অন্জন দত্ত এর একটা গান আছে না - "একটু ভাল করে বাচঁবো বলে আর একটু বেশী রোজগার,,"। সুভাষকে বললাম হেঁটে বাংলোয় যেতে কোনো অসুবিধা হবে কিনা??? বলল দিন দুয়েক আগে বাচ্চা সমেত লের্পাডকে ঘুরতে দেখেছে, তবে এই দাঁতাল থেকে ভয় নেই। ও বাংলোর আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়। নবদা সুভাষকে কিছু বলতেই সুভাষ আমায় বাংলো অবধি পথ দেখাতে রাজী হল। আলোচনায় ঠিক হল গাড়ীর টায়ার সারিয়ে নবদা ঘুরপথে বাংলোয় আসবে, ফেরার পথে সুভাষকে নামিয়ে দেবে। সুভাষ আমায় পৌঁছে দিয়ে না ফেরা পর্যন্ত ওরা অপেক্কা করবে। সদ্য চার মাসের বিবাহিত জীবন , সুভাষের ভরসায় নিজেকে সঁপে দেওয়া কি ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে ক্যামেরার ব্যাগ পিঠে নিয়ে নিলাম।
_______________________________________
সুভাষের সঙ্গে এগিয়ে চলেছি । পড়ন্ত বিকেলে অরণ্য পথে হেঁটে যাবার মজাই আলাদা। বৃষ্টির পর ভিজে ঘাসগুলো মাড়িয়ে চলেছি। ভাবী ঘাসের কি অপরীসীম সহ্য শক্তি।এই অরণ্যপথের মজা হল কিছুটা সোজা গিয়ে এমনভাবে বাঁক নেয় , আর প্রত্যেক বাঁকের খাঁজে কি চমক লুকিয়ে আছে তা হৃদয়াঙ্গম করাই বনভ্রমণের স্বার্থকতা। পথ ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে, জঙ্গল ও বেশ গভীর থেকে গভীরতম। দুধারের জঙ্গল চেপে ধরেছে রাস্তাকে। জোরালো হাওয়া জঙ্গলের খস্ খস্ শব্দ পাহাড়ে ঢাক্কা খেয়ে আবার এই জঙ্গলে ফিরে আসছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে সুভাষ কে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীতে কে কে আছে। উত্তর না দিয়ে বলল বাবু বাজে সময় জঙ্গলে এসেছো। একটা কজওয়ে ( জঙ্গলের রাস্তায় ছোটো ব্রীজ যার নীচ দিয়ে বর্ষার জল পাশ হয়।) পেরিয়ে আর একটু এগিয়ে সুভাষ দেখাল ভাঙা কজওয়ে যার জন্য গাড়ী আসতে পারছে না। পথের দুধারে ঘনিষ্ট হয় পাহাড়। চলে এলাম বাংলোর কাছে। পাহাড় ঘেরা ছোটো উপত্যকার মাঝে চর্তুদিক জঙ্গলে ঢাকা এই বাংলো। পেছনের দোতলায় চওড়া বারান্দা। সুভাষ বাংলো দেখিয়ে চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল। বাংলোর জং ধরা লোহার গেটে দাঁড়িয়ে তিনবার ডাক দিলাম - কোহি হ্যায় ???? গেটের চারপাশে ছড়ানো পর্ণমোচী এই অরণ্যের পড়ে থাকা পাতা বুঝিয়ে দেয় বহুদিন কারো পা পড়েনি এইখানে। আবার জোরে হাঁক দিলাম চৌকিদার,,,,,- --- মনে পড়ে গেল ওয়ালটার ডেলা মেয়ার বিখ্যাত লাইন - Is there any one there ???
________________________________________
****************
শেষ ডাকে বিকেলের চিঠি আসার মত দূর থেকে ততোধিক জোরে ভেসে এল - ঠ্যওরো- শব্দের উৎস হাত কুড়ি দূরে গুমটির মত একটা ঘর। কালো দেহাতি চেহারা, খালি গাঁয়ে টলতে টলতে সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমেই বলল বাংলো খালি নেহী হ্যায়। আমায় তাড়িয়ে দিতে পারলে যেন দায়মুক্ত। মুখ দিয়ে নেশা করলেও গা জুড়ে মহুয়ায় আমোদিত। রীতিমত ডুলছে। ওকে কিছু না বলে সোজা বাংলোয় উঠে এলাম। রুমের চাবি নিয়ে আসতে বলে বাংলোর পেছনের ব্যলকনিতে দাঁড়ালাম।সামনের দিকে চোখ পড়তেই সমান্তরাল খন্ড খন্ড ছেড়া মেঘের জ্যামিতি। বাংলোর কাঠের পাটাতনে অবসন্ন শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম। বেশ শীতল হাওয়া দিছ্ছে , গাছের পাতাগুলো উড়ে এসে আমায় জড়িয়ে দিছ্ছে । রকমারি তাদের আকৃতি আর রুপ, কারো হালকা সিঁন্দুর রঙ, একজনকে হাতে নিয়ে দেখলাম হলুদ সবুজ, আর কত ছোটো ছোটৌ পাতা আমায় বপূদী করে ফেললো। বললাম চা হবে কিনা ? স্নানের জল বাথরূমে আছে? রুমে ঢুকে তো চোখ ছানাবড়া ! ভাগ্যিস একা এসেছি। বউ সঙ্গে থাকলে নির্ঘাত ডির্ভোস। চৌকিদার আরও জানাল ও আলো পাখা সবই আছে কিন্তু চলে না। আমি বললাম রুমটা সাফ করতে। সাফ করবার পর ও রুম বাসযোগ্য হবে কিনা বলা মুশকিল। বিরক্তি আর দু:শ্চিন্তার দোটানায় মনোবল ই ভরসা।
________________________________________
মশার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর হাওয়ার বেগে বাংলোর ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বাঁশপাতার উড়ে দূরে সরে যাবার মচ্ মচ্ শব্দের তাল কাটল চৌকিদার এর হাতের বানানো চায়ে। ইছ্ছে করলেও কেউ এত খারাপ চা বানাতে পারত না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দূর থেকে ভেসে আসা গোঁ গোঁ শব্দে বুঝলাম গাড়ী আসছে। গাড়ী থেকে তিনজন নেমে এল। নবদা , সুভাষ ও সুনীল। রাত হয়ে গেছে তাই সুনীল আর বাড়ী ফেরেনি। আমাকে বাংলোয় নামাবার পর সুভাষ নবদাকে জানায় বাংলোর চৌকিদার এর ওপর ভরসা করা ঠিক হবে না। ও কাল আমায় জঙ্গল ঘোরাবে। রুমের অবস্হার কথা বলতেই তিনজন সরজমিনে দেখে গেল। প্রবেশদ্বারে বিশাল মাক্ড়সার জাল, তাতে নানা কিসিমের মাকড়সা , ভেতরে যা ধূলো তাতে হাফ 100 মিটার রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে, তেল চিটচিট্ বালিশ, তোশক বলে কিছু নেই আর চাদরের ওপর ব্যঙ, টিক্ টিকি, আর মরা আধমরা, জীবিত পোকা মাকড়। বাথরুম এর ছাদ দিয়ে জল চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে লোহার আস্তরণ আর শ্যওলা ধরা বালতি। কোনোরকমে ওই টর্চের আর কূপীর আলোতে বাসযোগ্য করা হল। বহু কষ্টে একটা মাদুর জোগাড় করে খাটের ওপর বিছিয়ে সঙ্গে আনা এয়ার পিলো আর বেডশীট (সব সময় আমার সাথে থাকে) পেতে দিলাম। সুভাষ চৌকিদারকে বলল কাঠ জ্বালতে। নীচে নেমে টিউবওয়েলের জলে স্নান। ঠান্ডা শীতল জলের এই অবগাহন শরীর সব টুকু শুষে নিয়ে আবার প্রাণের সঞ্চার করল। বাংলোর পেছনের বারান্দায় বসলাম। রান্নাঘরের দিকে যাব ভাবছি কিন্তু স্নানের সময় সুভাষের কঠোর নিষেধাজ্ঞা - বাবু রাতে উ দাঁতাল এই আশপাশ থাকে, বাংলো থেকে বেরোবেন না। টর্চ জ্বালিয়ে কুড়ি হাত ধূরে রান্নাঘরের দিকে নি:খেপ করতেই দেখলাম কাঠের আগুন জ্বলছে। টর্চ অফ্ করে দিলাম। একটা রাতচরা ডেকে চলেছে। এ জঙ্গলে নাইটজার( এক ধরণের পাখি) আছে যাদের অনবরত ডাক নিকষ অন্ধকারে জঙ্গলের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। একটা পেঁচা উড়ে গেল।একটা আলস্য জড়ানো মৃদু বাতাস গোটা অরণ্য জুড়ে। কখনো সে উছছলা কখনো বেশ ধীর। গাছের পাতা দুলছে, বাংলো চত্বর জুড়ে ঝরা পাতার উসখুসানি। বাংলোর নিকটদূর একটা ডোবা থেকে অজস্র ব্যাঙ ডাকছে। হঠাৎ ই ঝরাপাতা ঝড়ের রুপ নিল। ঝম ঝম করে বৃষ্টির আওয়াজ টিনের চালে। সুনীল হাঁক দিল সাহেব ডিনার রেডি।
     ________________________________________
চারদিকে ঘূটঘূটে অন্ধকারের মধ্যেই টর্চ আর মোমবাতির আলোয় ডিনার শুরু হল। একবারে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার । শাল পাতার তালায় ভাত, ডাল,ঝালডিম আর আলুমাখা। আলু ভাতে মাখছি আর ছোটো ছোটো পোকা কখনও ভাতের তালায়, কখনও ওই আধভাঙা টেবলে উড়ে পড়ছে। পোকা মাকড় দের যতটা না আমার খাবারে লোভ তার থেকে বেশী আলো কি বস্তু সেটা অনোধাবন করা। দু এক ফোঁটা বৃষ্টির জল ওপর থেকে টপ্ টপ্ করে হাতে পড়ল। কিভাবে খাওয়া শেষ করেছিলাম মনে নেই। ক্লান্ত শরীর টাকে নিশ্চিন্তে এলিয়ে দেব ভাবছি এই সময় প্রচন্ড জোরে চীৎকার করে উঠলাম। সবাই ছূটে এল। ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে আর মনে হচ্ছে সাপের মত কোনো বস্তু ওপর দিয়ে চলাচল করছে। চৌকিদার বলল তক্কক্ক । আমি প্রথম জানলাম এরকম একটা প্রাণী আছে। তবু ভয় কাটল না । সরীসৃপদের মধ্যে সাপকে আমার ভীষণ ভয় যদিও মানুষের থেকে এদের বিষ বহুগুণ কম। ভোরবেলা জংলী মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল।ভোরবেলার অরণ্যের অমোঘ আকর্ষণে আধো ঘুমচোখে ভেজা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখমুখ ভিজিয়ে দিল। এক পরম অনুভূতি। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে আলো ফুটছে। ভাবছি পাখি দেখতে বেরবো কিনা ! চৌকিদারকে ঘুম থেকে তুলে এক কাপ চা বানাতে বলে তৈরি হয়ে নিলাম। ধীর পায়ে বাংলোর হাতায় চলে এলাম। দু একটা পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। চৌকিদার চা এর কাপ হাতে দিয়ে দৃরে কিছু দেখালো। দেখলাম বাংলো থেকে কিছুটা দূরে ওই দলছুট দাঁতাল । ভেজা মাটিতে শূড় তুলে ধূলো ঝাড়ার ব্যার্থ প্রয়াস। মট মট করে দূ একটা বাঁশ আর গজিয়ে ওঠা জংলী ঝোপঝাড় ভাঙতে ভাঙতে চোখের আড়ালে। বেশ শান্ত প্রাণী। আমাদের টিপি মেম্বার মৌসুমী পাহাড়ী দিদি ও দুদিন আগে ডুর্য়াস এর হাতি নিয়ে ওনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। ক্যামেরা নিয়ে কিছুটা এগোতেই শেষ রাতে বাংলো চত্বরে তার সর্দপ উপস্হিতির যথেস্ট প্রমাণ। আকাশ আবার কালো হয়ে এল। চোখের সামনে একটা বেনেবউকে লেন্স বন্দী করতে যাব ঝমঝম্ বৃষ্টি নেমে এল। একসময় দূরের জঙ্গলটাও কালো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল। টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ। আবার ঘুমোতে গেলাম । ভাবছি বৃষ্টি না থামলে তো আর পাখী দেখা , জঙ্গলে ট্রেক করা হবে না। শুয়ে শুয়ে একটা গানের লাইন মনে পড়ল- মেঘ কালো আধার কালো,,, আর কালো ????
________________________________________
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। বাইরে ব্যালকনিতে এসে দেখি বৃষ্টিস্নাত অরণ্যে ঝলমল করছে রোদ। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যালকনিতে চেয়ারে বসলাম। সূর্যের আলো প্রতিটা পাতায় পাতায়। হাওয়াতে পাতাগুলো এমনভাবে দুলছে যেন রোদ কাঁপছে। যে ডাল ও পাতায় সূর্যের আলো বেশী পড়ছে পাখিরা একবার করে সেগুলোতে বসছে আবার অন্য ডালে গিয়ে বসছে। পুরো বাংলো চত্বর জুড়ে কত রকেমের যে পাখীর ডাক, চন্দনী ; কাকাটিয়া, মৌটূসী , কুবো , বুলবুল আরো অনেকের কূজন। সামনের ডোবার ঠিক পরে একটা আধা বাঁশের ছোটো লগির ওপর মুখে মাছ নিয়ে বসে আছে ব্লু ইয়ার কিং ফিশার।সম্বিত ফিরল চৌকিদার এর ডাকে বাবু নাস্তা ক্যায়া বানাউ ? হাত থেকে চা এর কাপ হাতে নিয়ে বললাম রোটি আর সবজী ফ্রাই। চা খেয়ে তৈরি হয়ে ক্যামেরা নিয়ে বেরোলাম। শুনলাম সুনীল চলে গেছে। কিছু পাখীর ছবি তুলছি , ফিল্ম বাচিয়ে তুলতে হচ্ছে । কোথায় থেকে একপাল হরিণ বাংলো চত্বরে চলে এল। তাদের শরীরে স্ফটিক এর মত সূর্যের আলো পড়ছে । একসঙ্গে এত হরিণের পাল আগে কখনও দেখিনি। পরবর্তী সময় ভিতরকণিকার ডাংমল বন বাংলো আর নাগের হোল বন বাংলোতে অনেক হরিণ দেখেছিলাম। দূটোই খুব সুন্দর জঙ্গল, আপনারা সময় সুযোগ পেলে যাবেন বিশেষ করে ভিতরকণিকা। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেখানে আটটি প্রজাতির মাছরাঙা পাওয়া যায়। জলখাবার খেয়ে চৌকিদার রামনরেশ কে বললাম ভালো করে ঘর পরিস্কার করে রাখবে। নবকিশোর আর সুভাষকে নিয়ে তিন কিমি দূরে নজরমিনার এর দিকে হাঁটা দিলাম। কিছূটা গাড়ীতে যাবার পর নেমে হাঁটতে লাগলাম। ছোটো ছোটো এবড়ো খেবড়ো নুড়ি পাথর ফেলে এ পথ বানানো হলেও বোঝা যায় বহুদিন এ পথে গাড়ী চলাচল একবারেই নেই। পথ ঢাকা পড়ছে বনঘাসের ঝোপ আর ছোটো বুনো গাছের আগাছায়। সুভাষ রাস্তা করে দিছ্ছে আর আমরা ধীরলয়ে পদব্রজে আগুয়ান। একটা বার্কিং ডীয়ার চকিতে রাস্তা পেরিয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে বলি যেকোনো টাইগার রির্জাভ যদি বার্কিং ডীয়ার এর কল্ শুনতে পান তাহলে জানবেন বাঘ বা লের্পাড আশে পাশেই আছে। অলমোষ্ট 100% কল্ অ্যাকুরেশী। ইতিউতি দেখতে দেখতে পথ চলেছি। দুপাশে জমাট বাঁধা ঝোপঝাড়। কানধা উপজাতীর মানুষ সুভাষ দক্ষতার সাথে পথ দেখাছ্ছে । চিনিয়ে দিচ্ছে প্রচুর লতা গুল্ম , বন গাছ আর তাদের গুণাবলী। বৃষ্টির জন্য কিছু জায়গায় পথ পিচ্ছিল , জলকাদার মধ্যেই সাবধানে পা ফেলছি। শ্যওলার চাদরে মোড়া প্রকান্ড সব মহীরুহ যা সূর্যালোকের অস্পৃশ্য। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর স্যাঁতস্যাঁতে এই বনপথের ধারে তৈরি হওয়া মাটির ঢিবিগুলোতে স্পষ্ট বন্যশূয়োরের পদচিহ্ঞ। চলতে চলতে কিছুক্ষণ পর পর সূর্যের আলো অরণ্যে এসে পড়ছে। কখনো পথ বেঁকে ডানদিকে কখন পথ বেঁকে বামদিকে। পৌছে গেলাম ব্রিটিশ আমলে তৈরি নজরমিনারে। 
আমার ব্যাক্তিগত অভিমত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আর কিছুদিন থাকলে ভারতবর্ষের লাভ বই ক্ষতি হত না।অরণ্যের মাঝে সমতল থেকে উঁচু ফাঁকা জমিতে দন্ডায়মান ইংরেজ আমলের ঐতিহ্য বহন করা বন্যপ্রাণী দর্শনের এই জীর্ণ স্তম্ভ। এই জীর্ণ স্তম্ভ গুলোই এক একটা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। কত ইংরেজ ; তার থেকে বেশী দেশী জমিদার, রাজন্যবর্গ, তাদের সুপুরুষ / কাপুরুষ বংশধররা, চোরাশিকারীদের আতুঁড়ঘর এই নজরমিনার গুলো কত বন্যপ্রাণীর আর্তনাদের ইতিহাস বহন করছে তার মূল্য আমরা এখন দিচ্ছি আর আগামী প্রজন্ম তো সেগুলো ইতিহাসের পাতায় পড়বে। যে কোনো অরণ্যের রুপ দর্শনের আর্দশ জায়গা এই ওয়াচটাওয়ার। দ্বিপ্রাহরিক এই সময় বেশীরভাগ বন্যপ্রাণী জঙ্গলে তাদের নিজেদের আস্তানায়। উঠে এলাম ওয়াচ টাওয়ারে। সামনেই একটা ওয়াটারহোল। ফিঙে, মাছরাঙা, কোঁচবক সব শিকারের সন্ধানে।কিছুদিন আগে নাকি বাঘ এখানে বন্য শুয়োর মেরেছিল। ভয়ে সুভাষরা তিনদিন কাঠ কাটতে পারেনি। জলাশয়ের চারপাশে প্রায় তিরিশ চল্লিশ ফুট উচুঁ বাঁশগাছ, শাল , সেগুন,গামার, শিরিষ, কেন্দুর সমাহার। একদম গা ছ্মছ্মে পরিবেশ। ঘন জঙ্গলের মাঝে এই জলাশয় বন্যপ্রাণীদের পিপাসা ও যাতায়াত এর অন্যতম করিডর। সুভাষ বলল রাত্রে এই নজরমিনারে থাকতে চাই কিনা ? পরিশ্রান্ত হয়ে চোখে মুখে জল দিলাম। অদ্ভুত নি:স্তবধতার মাঝে অধীর আগ্রহে বসে আছি কখন তিনি বা তারা আসবেন পিপাসা মেটাতে। - মনে পড়ে গেল Ralph Emerson er সেই বিখ্যাত উক্তি - " Adopt the pace of Nature her secret is patience"
________________________________________
কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর একধরনের গুড়িগুড়ি পোকা চোখের সামনে মুখে এসে বসতে লাগলো। দুদন্ড বসতে বা দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এরকম গুড়ি গুড়ি পোকা পরবর্তী সময় অনেক জঙ্গলে পেয়েছি। এক জায়গায় বসে থাকাই দায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এসে ফেরার পথ ধরলাম। বর্ষা শেষে এ অরণ্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে সমস্ত রূপ রস গন্ধ। ফেরার পথে নজর চলে গেল পথের দুপাশেগাছের তলায় ইত:স্তত বিচরণ করা বন্যশূয়োর আর চিতলের দিকে।অন্য পথ দিয়ে ফিরছি, দূর থেকে কূল কূল শব্দ ভেসে আসছে। হেঁটে হেঁটে উৎস স্হলের কাছে গিয়ে দেখি একটা নালা, বর্ষার জল পেয়ে পরিপুষ্ট, সুভাষের ভাষায় বর্ষার সময় বন্যপ্রাণীদের পিপাসা মেটাবার উৎস এই নালা। আমায় স্মরণ করিয়ে দিল আসার দিন যে লের্পাড আর তার বাচ্চা আমি দেখেছিলাম তারা প্রায়ই এই নালায় পিপাসা মেটাতে আসে। নালার চারপাশে বেশ বড় বড় গাছ, কিছু গাছের ফাঁক দিয়ে রৌদের ফুটকি ফুটকি আলো নালার জলে পড়ছে। একটু দূরে দূটো সম্বর জলপানে মগ্ন । ছবি নিলাম।আবার চলতে শুরু করলাম, খানিকটা এগিয়ে একটা বাঁক নিয়ে মূল ওয়াচ টাওয়ার যে পথে গিয়েছিলাম সেখানে এলাম। হুপী, চন্দনা, ভগীরথ আর বসন্ত বৌরির দেখা পেলাম। আবার কিছুটা এগিয়ে সুভাষ অন্য পথ ধরল। সুভাষ আর নবকিশোর দুজনকেই দেখছি কোনো বিরক্তি নেই। সুভাষ যদি হয় অরণ্যের ভূমিপুত্র, নবদা তাহলে অরণ্যের পরম মিত্র। সুভাষ না জানে কোনো গাছ বা বন্যপ্রাণীর ইংরেজী বা বিজ্ঞানসম্মনাত নাম, তথাকথিত ন্যচারিলিষ্ট নয়, কিন্তু অরণ্য রক্ষায় ব্রতী দক্ষ এক সৈনিক। এ জঙ্গলের সমস্ত বন্যপ্রাণী আর গাছ যেন সুভাষের সন্তান। অরণ্য ভ্রমণে এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি যাদের না ছিল কোনো প্রথাগত শিক্ষা না ছিল কোনো অর্থের লোভ। শুধু জঙ্গলকে ভালোবেসে উৎর্সগ করেছে নিজেদের জীবন। আর আজকাল ফেবু তে দেখতে পাই এরকম কত মধ্য মেধার বিচরণ। একটা DSLR হলেই wildlife photographer .বাঘবনে গিয়ে একটা বাঘের ছবি তুললেই বন্যপ্রাণী বিশেযজ্ঞ। অরণ্যের ছাত্র হিসাবে বলতে পারি এতে বন্যপ্রাণীদের দূর্দশা বেড়েছে। এ পথে কিছু হনুমান , মূয়র দেখলাম। এ পথে জঙ্গল বেশ ঘন। কিছুটা যাবার পর অনেকটা দূরে কিছু ঘরবাড়ী দেখতে পেলাম । অরণ্যের আদিম বসতি। অরণ্যের একপ্রান্তে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির ওপারে তাকিয়ে ভাবলাম কালের নিয়মে একদিন হয়ত এদের এই অরণ্য থেকে চলে যেতে হবে বা বলপূর্বক উৎখাত করতে হবে। খিদের তাড়নায় বাংলোয় ফিরলাম। রান্না ঘরে ঢুকলাম, ঘরের একদিকে মাটির বড় উনুন, অন্যদিকে রাখা কাঠ, আর একদিকে মশলাপাতি রাখবার কাঠের তাক্। ওপরে টিনের ফুটো দিয়ে আলো আসছে। লাঞ্চ করে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়াতে যাব চৌকিদার এসে একটা নতুন ঘর খুলে দিল যা অফিসারদের জন্য নির্দিষ্ট। চেয়ার নিয়ে বসে সিগারেট খেতে খেতে উপভোগ করছি পড়ন্ত দুপুরের অরণ্যের ঝিম ধরা নিস্ত:বধতা।
***সমাপ্ত***


Comments