সবই মায়া
রূপঙ্কর সরকার
কিছুকাল আগে, যখন চাকরির কাজে এদিক ওদিক ঘুরতে হতো, সে সময়ে আমাদের সংস্থায় একটা রসিকতা চালু ছিল। কেউ হয়ত খুব আন্তরিক ভাবেই নিজের কিছু দুঃখের কথা বলছে, যাতে অন্যরা ঠিক সমবেদনা জানাবার অবস্থায় নেই। এমন হতেই পারে। একমাত্র স্বজনবিয়োগ ছাড়া অন্য ব্যথা শেয়ার করতে নেই। সকলেরই নানা সমস্যা, এগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তা যিনি বললছেন, তিনি কাতর হয়ে পুরোটা বলে ফেলার পর কেউ একজন একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, ‘সবই মায়া’।
অবশ্য আমার লেখার পরের অংশের সঙ্গে এই ভূমিকা কতটা তাৎপর্য রাখবে তা আমি বলতে পারবনা। এই ট্র্যাভেলগটির কী শিরোনাম হবে, তা নিয়ে ট্রেনে ফেরবার সময়ে দীপঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। আমি যে কটি বললাম, যেমন একটি –‘বাঘসফরে বাগবিতণ্ডা’, একেবারে লালমোহন গাঙ্গুলি স্টাইল। কিন্তু দীপুর তা পছন্দ নয়। কেন তা বলছি পরে। শেষে দেখলাম টাইটল হেডে অতখানি আঁকবার চেয়ে এটাই সহজ। তাই এটাই রইল – ‘সবই মায়া’।
এই প্রসঙ্গে, আমার ট্র্যাভেলগ আমার পুরনো বন্ধুরা পড়ে অভ্যস্ত। তাঁরা জানেন এই লেখা কেমন বা কী কী থাকে। যাঁরা নতুন এসেছেন, তাঁদের বলি, এ লেখা পড়া তো বাধ্যতামূলক নয়, ফেসবুকের কোনও লেখাই তা নয়। ইচ্ছে না হলে পড়ে সময় নষ্ট করবেন না একদম। আমার নিকটবান্ধব ছাড়া অপরে না পড়লেই খুশি হব আমি। যখন আপডেট দিচ্ছিলাম, গ্রুপ ছবি দেখে একজন দুম করে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার স্ত্রী কোথায়?’ আমি ছ’বার উত্তর লিখে মুছে দিয়ে শেষে অনেক কিছু সংবরণ করে লিখলাম, ‘বাড়িতে’। যাঁরা আমাকে চেনেন না, আমার পরিবারের ইতিবৃত্ত জানেন না, তাঁরা এসব লেখা না পড়লে বা ছবি টবি না দেখলে আমি বাধিত হব। পাবলিক পোস্ট তো অনেক থাকে, সব পড়তে হবে, দেখতে হবে, তা কোথায় বলা আছে? আর দেখলেই মন্তব্য করতে হবে, তাই বা কোথায় লেখা আছে। আমি খুব কটু কথা বলতে সক্ষম। নেহাৎ অনেক অল্পবয়সি সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি থাকে বলে সে পথ পরিহার করি।
আর একটা কথা, আমার লেখা ‘ভ্রমণকাহিনী’ নয়। একেবারেই নয়। এই প্রসঙ্গে, বিখ্যাত ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার মালকিন স্বয়ং আমার বন্ধু তালিকায় আছেন। তিনি নিজেই আগ্রহ করে এসেছেন। কিন্তু আমি তাঁর পত্রিকায় কোনওদিন লেখা পাঠাইনি। কারণ আমার লেখা ‘ভ্রমণকাহিনী’ নয়। আমাদের দীপঙ্কর নিয়মিত সেখানে লেখা দেয়, বিপিন নাকি ছবি দেয় শুনছি, আমি কিছুই দিইনি কোনওদিন। আমার লেখা ফেসবুকে থাকে, যার ইচ্ছে পড়েন, তবে এমন মন্তব্য করবেন না, যাতে আমাকে কটুকথা বলতে বাধ্য করা হয়। আমি কটু কথা কোনওদিনই বলবনা, সোজা ব্লক করে দেব।
ভূমিকা হল, এবার যাত্রা শুরু করার আগে কিছু প্রারম্ভিক কথা। আমার ট্যুর কমে আসছে ধীরে ধীরে। কিন্তু বাইরে যাওয়া আমার একান্ত দরকার, না হলে আমি বাঁচবনা। অবশ্য বেঁচেই যে দেশোদ্ধার করব, এমন নয়। তবে মরতে আমার ইচ্ছে নেই কোনও। তা ট্যুর কমে আসার কারণ, আমি তিনটি গ্রুপে চলাফেরা করি। জয়দীপদের গ্রুপ হয়ত বৃদ্ধ বলে আমাকে বিশেষ চায়না, তাই তাদের ঘোরাফেরার খবর পাইনা। সোমনাথ আর সুভাষের সঙ্গে কয়েকটা প্ল্যান করা আছে, দেখা যাক কী হয়। দীপঙ্করের গ্রুপেই আমার বেশি ঘোরাঘুরি ছিল। কিন্তু এখন আমি অ্যাফোর্ড করতে পারিনা। ওখানকার বেশির ভাগ সদস্য আক্ষরিক অর্থে আমার ‘দশ গুণ’ বা আরও বেশি রোজগার করেন, তাই তাঁদের সঙ্গে তাল মেলানোর ইচ্ছে থাকলেও পারিনা আমি।
তবে এবারের ট্যুরে তন্ময়-সঞ্চিতা ছিল, বিপিন ছিল, দীপঙ্কর তো ছিলই। আর খবর পেলাম অন্য একটি পরিবার, যাঁদের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় না থাকলেও তাঁরা খুবই আমুদে ও মিশুকে। তাই ঝুলে পড়লাম। আমার অ্যাক্রোফোবিয়া আছে, তাই প্লেনে চাপিনা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। চাকরির সময়ে চাপতেই হত বাধ্য হয়ে। আমি আর দীপঙ্কর ট্রেনে যাব। বাকিরা প্লেনে অবতরণ করবে বিভিন্ন সময়ে। ততক্ষণ নাগপুর শহরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
এর মধ্যে সুস্মিতার কমেন্ট কোনও এক পোস্টের নীচে, - দাদা নাগপুরে আসছেন, আমার বাড়ি আসবেন না? কিন্তু সেই পোস্ট দেখা, উত্তর দেয়া, ফোন করে ঠিকানা জানা ইত্যাদির মধ্যে অনেক সময়ের ব্যবধান। কারণ মাঝে মাঝেই নেট ও টাওয়ার আসছে আর যাচ্ছে। সময়মতো সুস্মিতার ঠিকানা পেলে নাগপুরে নেমে পথে পথে ঘুরতে হতনা।
যাক ট্রেনের কথা বলি। ট্রেনে আমাদের সঙ্গে একটি পরিবার। মা বাবা আর বালক পুত্র। এমন ছেলে আজকাল দেখা যায়না। হাতে ট্যাব, তাতে খুটখাট করছে বটে, কিন্তু ছেলে পঞ্চাশের দশকের। এত বাধ্য, এত ভাল, এত শৈশব ধরে রাখা ছেলে কলকাতায় এযুগে দেখিনা। মা বাবা তার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলেন। কিন্তু তার বাংলা খানিক আড়ষ্ট, অনেক শব্দই ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেনা। স্কুলে তিনটি ভাষা আবশ্যিক। সে নিয়েছে ইংরিজি, হিন্দী আর সংস্কৃত। যাক তাও ভাল।
রাতে তো এগারোটায় চেপেছি। তাই শুয়েই ঘুম। সকালে উঠে খেতে হবে তো। রেলের খাবার একে জঘন্য তায় ছাপা দামের ঠিক ডাবল নেয় আজকাল। পয়সা দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু চুরিগুলো মেনেও নেওয়া যায়না। প্রতি যাত্রীর কাছে ৫০/৫৫ টাকা বাড়তি নিলে তাদের নির্ধারিত আয়ের থেকে কত বেশি দাঁড়ায়? দীপঙ্কর তাই নেটে অর্ডার দিয়েছে ট্র্যাভেলখানা ডট কমে। এসে গেল পোহা। অতি সুস্বাদু এবং একটা নিলেই অনায়াসে দুজনের হয়ে যেত। আমি বললাম, ছবি তোল। চলন্ত ট্রেনে হাত না কাঁপিয়ে মোবাইল ফোনে ছবি তোলায় দীপঙ্করের জুড়ি নেই। তাও আমার ফোন মাত্র হাজার দশেকের। এমন কিছু দামি নয়, যাতে এত মেগাপিক্সেল, এত লো লাইট ফোটোগ্রাফি, হ্যানা ত্যানা সব রয়েছে।
মলাটে হাওড়া। ঘড়িতে দশটা একুশ, বাঁদিকে দীপঙ্কর।
***************
ভাল সহযাত্রী, জমানো গল্পগুজব, দিব্য হচ্ছিল ট্রেনযাত্রা। আমি একটা কথা মনে পড়লে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিই আপন মনে। তা হল দীপঙ্কর কোথাও যাওয়ার সময়ে গোটা দুত্তিন খবরের কাগজ কিনবেই। কিন্তু কাগজ পড়তে কেউ দেখেনি তাকে কোনওদিন। আজ আবার একটা দৈনিক পত্রিকার সংগে ইকনমিক টাইমস কিনেছে। এটাও ও প্রায়ই কেনে। একসময়ে আমি এই কাগজ পড়তাম, কারণ আমার চাকুরিসূত্রে প্রয়োজন হতো। কিনতে হতনা, অফিস থেকে গোটা তিনেক কাগজ পেতাম। এত বিরক্তিকর কাগজ মানুষ কী করে পড়ে আমি ভেবে পাইনা। আমি পড়তাম, আসলে পড়তামনা, নানা জিনিস টুকতাম। তা আমার কোম্পানি প্রোফাইল তৈরিতে কাজে লাগত বলে। আর একবার মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার দর দেখতাম। সে মাথাও আর নেই, সে মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু দীপঙ্কর প্রতি ট্যুরেই কেনে কেন? খাবার সময়ে পাতবার জন্য? তা তো যে কোনও কাগজ দিলেই হলো, লাল হোক বা সাদা। যাকগে থাক এখন প্যাচাল।
দেখতে দেখতে দ্বিপ্রহরের খাবার এসে গেল। দীপঙ্কর আমার জন্য ভেজ থালি আর নিজের জন্য চিকেনের কী একটা রেজালা টাইপ নিয়েছে। আমি বকলাম। আমার থালিটা দুজনে খেয়েও শেষ হতনা। কিন্তু ওরটায় অনেক ফাঁকিবাজি। আমি আমার থেকে অনেকটা ওকে গছালাম, কারণ অত খাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না। খাবার কিন্তু খুবই স্বাদু ও উৎকৃষ্ট ছিল।
এই সময়ে দীপঙ্কর একটা জিনিস আবিষ্কার করল। দেশে ভাল কিছু তো কোনওদিন হয়না। কিছু হলে আমরা উৎসাহিত হই। আগেই বলেছি, বেশ কয়েক বছর দেখছিলাম, রেলের প্যান্ট্রিতে এখন বাইরের কন্ট্র্যাক্টরদের আউটসোর্স করা হয়। তারা খাবারের যে দাম লিস্টেড তার ঠিক ডাবল নিত। কেউ আপত্তি জানালে হুমকি, এমনকি মারধোরের খবরও পড়েছি কাগজে। দীপঙ্কর বলল, এখন খাবারের প্যাকেটের ওপর দাম প্রিন্ট করে আসছে। জয় সুরেশ প্রভু(ইনি রেলমন্ত্রী)। কে বলল ভাল কাজ হয়না। আর কাজ যে কী সাংঘাতিক হয়, তা টের পেলাম ফেরার সময়ে। সে তখনকার কথা তখন বলব।
আমাদের নামার সময় হল এবার। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। ভাবলাম যাক, নাগপুরের ৪৪ ডিগ্রীতে সেদ্ধ হতে হবেনা তাহলে। বৃষ্টি হয়ে খানিক ঠাণ্ডা হবে। নাগপুর শহরটা কর্কটরেখার ঠিক ওপরে। তাই মারাত্মক গরম। তার ওপর শুকনো গরমও নয়, বেশ হিউমিড। নাগপুর স্টেশনের ওভারব্রিজটা সম্ভবত সাহেবি আমলের, ইটের হাতল, ইটের গাঁথনি, তায় লাল রঙ করা। দেখলে নস্টালজিয়া আসবেই। সেই কবেকার মতো।
নেমে দেখি বৃষ্টি তখনও পড়ছে, তবে টিপটিপিয়ে। আমার একটা ছবি তুলল দীপঙ্কর।
আমার বেশ বড়সড় লাগেজ দেখে ফেসবুকে অনেক কমেন্ট, এত বড় বাক্স তো এক জামা পরে
ঘুরছেন কেন, ইত্যাদি। আমি বহু চেষ্টা করে দেখেছি, কিছু মানুষকে বেড়াতে
যাওয়া আর বার্ডিং ট্যুরের তফাত বোঝানো যায়না। ফেসবুকেই অনেক ছেলে বা মেয়ে
লেখে – কাকু আবার বেড়াতে যাচ্ছ? বাহ কত বেড়াও তুমি। আমি হতাশ হয়ে আর বলিনা
কিছু। হ্যাঁ, বাক্সটা বড়, কারণ ওতে চারটে চাকা আছে, টানতে সুবিধে। জামাকাপড়
ছিল দুতিনটে। তার বেশি লাগেনা।
নাগপুর স্টেশন থেকে বেরোতেই ঠিক এনজেপি স্টেশনের মত একটা আগেকার এঞ্জিন
রাখা আছে। সম্ভবত সেই বেঙ্গল-নাগপুর বা ‘বিএনআর’ এর সময়কার। কত কথা মনে পড়ে
যায় এসব দেখলে। যাক এঞ্জিনের নীচেই গাড়ি পার্ক করা ছিল, আমরা গিয়ে উঠে
পড়লাম।
গাড়ির সারথীর নাম সাহুজি। মানুষটি নাগপুরে গাড়ি চালালেও আদপে লোক ছত্তিসগড়ের, সেটা পরে জানলাম। আসলে এই জায়গার ভৌগলিক সীমা টানা খুব মুশকিল। যেমন ছত্তিসগড় আলাদা হওয়ার আগে পুরোটাই মধ্যপ্রদেশ ছিল। আবার মধ্যপ্রদেশের বেশ কিছুটা অংশে মারাঠিভাষীদের প্রাধাণ্য। অন্য দিকে মালওয়ি, বুন্দেলখণ্ডি, আবার বেশ কিছু অঞ্চলে গুজারাটিদের বাস। আবার এই নাগপুর এককালে মধ্যপ্রদেশের অংশ ছিল, যেমন বাংলায় ছিল কাটিহার পূর্ণিয়া এইসব। যাই হোক আমাদের সাহুজি নাগপুরে গাড়ি চালালেও অনেক কিছুই জানেন না নাগপুরের তা পরে জানা গেল। আমরা বললাম, সাড়ে সাতটায় এয়ারপোর্টে যেতে হবে। হাতে অনেক সময়। তাই পথে পথেই ঘোরান আমাদের। প্রথমে চলুন একটু চা টা খাওয়া যাক।
কী দুঃখে যে চায়ের কথা বলল দীপঙ্কর। আবার বলল, ‘অ্যা্যসে জগা লে চলিয়ে জাঁহা সিঙাড়া টিঙাড়া মিলতা হ্যায়(মানে সমোসা উমোসা)’। তা সাহুজি এক জায়গায় নিয়ে এসে হাজির। সেটা ওখানকার কোর্টের সামনে স্ট্রিট ফুডের একগাদা স্টল। তার মধ্যেই যেখানে বেশি ভিড়, সেখানে না গিয়ে উল্টো ফুটাপাথে একটা ফাঁকামতো জায়গায় আনলেন সাহুজি। বললেন, ইয়াহাঁ সামোসা, পাতুড়ি সব মিলতা হ্যায়। বহোত বঢ়িয়াঁ হ্যাঁয় ইয়াহাঁকা পাতুড়ি।
আরে ভাই পাতুড়িটা কী বস্তু? আমি তো জানি ইলিশের বা খয়রা মাছের পাতুড়ি। মানে পাতায় মুড়ে সর্ষেপোস্ত বেটে দিয়ে ভাপে সেদ্ধ। তা এখানেও পাতুড়ি? তাও আবার রাস্তায়?
আজ হচ্ছে সেই অমোঘ দিন, যখন সেই অপ্রিয় কথাটা আমাকে বলতেই হবে। এদিকে রঞ্জিতবাবু ফ্রেন্ড লিস্টে এসেছেন। আরও অন্তত দুজন সেই সংস্থার কর্মী আছেন আমার বন্ধু তালিকায়। তাই যথাসম্ভব বিনয় দিয়ে শুরু করি। মানে আপনার দেহসৌষ্ঠব এর প্রশংসা করলাম, আপনার মুখশ্রীর ভূয়সী প্রশংসা করলাম, এবার ‘রাণী ভানুমতীর’ হাঁটুতে যে একটা কালো কুচকুচে তিল আছে, তার উল্লেখ করবনা, এমন ‘কালিদাস’ হওয়া কি উচিত? আপনারাই বলুন।
***************
কোনও একটা ‘ভাল’ শহরে এলে ভাল লাগতে বাধ্য। এই যে হাইকোর্টের সামনে স্ট্রীট ফুডের দোকানের সারি, তাঁরা তো খাবারই বিক্রী করছেন। মানুষজন তা ভিড় করে কিনছেনও। কিন্তু কী সুন্দর সুশৃঙ্খল ব্যাপারটা। কলকাতায় ঠিক হাইকোর্টের সামনে না হলেও সামান্য তফাতে প্রচূর স্ত্রীট ফুড। সারা ডালহাউসি স্কোয়্যার জুড়েই খাদ্যের সম্ভার রাস্তার রাস্তায়। কেমন নোংরা, শালপাতা, থার্মোকলের প্লেট রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, ফুটপাথের ধারে নর্দমায় উপুড় হচ্ছে ভাতের ফ্যান। সেদ্ধ করা নুডলস বেতের ঝুড়িতে গামছা চাপা দিয়ে রাখা থাকছে চারটে ইটের ওপর। তার ওপরেই কালো কুকুর ঠ্যাং তুলছে কিনা কেউ দেখতেও যাচ্ছেনা। কিন্তু নাগপুরে এসে মনেই হবেনা স্ট্রীট ফুডের দোকানে ঢুকছেন, এতই শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাপারটা। মুম্বাইতে মাহিম দাদারএও তেমনই দেখেছিলাম। গ্র্যান্ট স্ট্রীটের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। তা আবার চেঁচিয়ে বলাও যাবেনা। যাক ছোড়িয়ে।
আসলে নাগপুরের রাস্তায় রাস্তায় খানিক ঘুরলেই বোঝা যাবে ‘এলেম নতুন দেশে’। বড় ভাল লেগে গেল জায়গাটা। শহরের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা আর দুধারে সবুজে সবুজ সারিবদ্ধ গাছ দেখলে মনে হয়, আমাদের শহরটা এমন নয় কেন? কলকাতায় বাসরাস্তা যেখানেই আছে, দুধারে রাস্তার ওপর ফুটপাথ জুড়ে অস্থায়ী(?)দোকান আর ঝুগ্গি ঝোপড়ি। সারা কলকাতার যেখানেই যান একই দৃশ্য। লাউডন স্ট্রীটে আর রডন স্ত্রীটের ওখানে ফুটপাথের ওপরই, ঠিক মাঝখানে পাইখানা করে রাখে কেউ। সে আমি উনিশশো আশি সালেও দেখেছি, দুহাজার পাঁচেও দেখেছি। মনে তো হয়না একই লোক। কেন আমাদের শহরটা এমন নয়? এমন সুশোভিত শহর ছেড়ে দিন। ভারতের অন্য কোনও শহরেই এমন দৃশ্য সারা শহর জুড়ে নেই। থাকলে আছে কয়েকটি ‘বিশেষ’ এলাকায়। পৃথিবীর সব গরিব লোক বঙ্গদেশে থাকেন? নাকি ‘পোশাসোন’ বলে এখানে কিছু নেই?
যাই হোক, আফশোস করে আর কী হবে, চলো ভাই কোথায় সিঙাড়া পাতুড়ি পাওয়া যায় দেখি। আসলে আমি খেতাম না। বিশেষ খিদে যে পেয়েছিল, তাও না। তবে ওই পাতুড়ি নামটা শুনেই কৌতূহল হলো, ব্যাপারটা কী দেখাই যাক না। তো গেলাম সেখানে। পাশাপাশি একটা ডেগচি(ডেকচি) আর একটা ঝুড়ি। ডেগচিতে একটা হলদে রঙের তরল পদার্থ ভর্তি, তাতে সবুজ সবুজ কী যেন ভাসছে। আর ঝুড়িটায় সিঙাড়ার মত দেখতে প্রকাণ্ড কী সব ভাজা জিনিষ রাখা আছে। সিঙাড়াও ছিল। শুনলাম তেকোণাটা সিঙাড়া(সামোসা) আর লম্বা চৌকোটা পাতুড়ি। জীবিনে নাম তো শুনিনি এমন পাতুড়ির। খেয়েই দেখা যাক। দীপঙ্কর অবশ্য সিঙাড়াই খাবে স্পষ্ট ঘোষণা করল। এবার বিশাল চেহারার অধিকারী সাহুজি গিয়ে দোকানদারকে বললেন, ‘এক সামোসা অওর দো পাতুড়ি বনাও’। তিনিও বলেছেন আর দোকানদারও শুনেছে। একটার পর একটা লোক আসছে আর খবরের কাগজের কাটা পাতায় করে সামোসা পাতুড়ি ভরে নিয়ে যাচ্ছে। সাহুজি রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছেন – ‘তিন বনাও’। তিনি বার পঁচিশেক বললেন বোধহয়। আসলে ড্রাই খাবারগুলোই যখন হট-কেক বা বলা উচিত হট পাতুড়ির মতো উড়ে যাচ্ছে, তখন কষ্ট করে আর বানায় কে। যাক একসময়ে হাত একটু ফাঁকা হতে দোকানদার ‘বানাল’। বানানো মানে কী? একটা প্লেটে সেই পাতুড়ি/সিঙাড়া দিয়ে, সেটা একটা ভোঁতা চামচ দিয়ে বার কয়েক ভেঙে তার মধ্যে সেই হলুদ তরলটা ঢেলে দিল।
একে তো প্রচণ্ড গরম ছিল জিনিষটা। খুব গরম খাবারের স্বাদ বোঝা যায়না। যাই হোক। সময় নিয়েই খেলাম। তবে খেতে খেতে মনে হচ্ছিল, খুব অন্যায় করছ রূপঙ্কর সরকার, থামো এবার, থামো। অর্ধেকটা খেয়েই প্লেট নামিয়ে দিলাম। মোটেই ভাল লাগেনি খেতে। অথচ ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করার পর যাঁরা আগে খেয়েছেন, তাঁরা তো খুব সুখ্যাত করলেন। আমাদের রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্যান্যাল ওরফে ঘনাদা তো বললেন খেতে বেশ ভাল, তিনিও খেয়েছেন নাকি এককালে।
সাহুজিকে জিজ্ঞেস করলাম, রেসিপিটা কী। তিনি বললেন ভেতরের পুরটা হয় জিরে দিয়ে ভাজা ছোলার ডাল। তার সঙ্গে প্রচূর পরিমাণ ধনে আর আদা রসুন বাটা, কিছুটা ‘খসখস’ অর্থাৎ পোস্ত। আর বাইরের খোলটা ময়দার, সিঙাড়ার মতই। আর ওই তরলটা? সেটা হল খুবই তরলীকৃত দই, বেসন, আদা-রসুন বাটা আর হলুদ, এগুলো গোলা, তার ওপরে ধনেপাতা। আমি অবশ্য পাতা একটিও দেখিনি, সবই ধনে গাছের খণ্ডিত অংশ। পুরো ব্যাপারটা ধনে-র গন্ধে ম’ ম’ করছিল। আদা-রসুন-ধনে এবং আর যা যা শুনলাম, সব একসঙ্গে যেতে পারে, এতেই যারপরনাই বিস্মিত হয়ে অর্ধেকটা যে খেয়ে ফেলেছি, তাতেই অনুতপ্ত হয়ে বললাম, আভি চলিয়ে শহর কে বাহর কহীঁ লে চলিয়ে।
নাগপুর শহরের কিছু এলাকা ঝকঝকে, তকতকে, গাছে গাছে ভর্তি। আবার কলকাতার গাছ
না, যে –‘অতি বাড় বেড়োনা, ঝড়ে পড়ে যাবে’। এ গাছগুলোর উচ্চতা বেশি না প্রসার
বেশি। দেখলে চোখ জুড়োতে বাধ্য। অবশ্য কিছু ঘিঞ্জি এলাকাও নেই তা নয়,
ক্রমবর্ধমান মনুষ্যজাতির কবলে সবুজে চাপ পড়তে বাধ্য। কিন্তু তবুও দেখলাম,
সেই সব ছিরিছাঁদহীন কঙ্ক্রিট জঙ্গলেও ঘেথা হোথা গাছ উঁকি মারছে। কলকাতায়
কোনও প্রোমোটার বাড়ির হাতায় গাছের চিহ্ন রাখ না। এখানে রাখে, রাখতে বাধ্য
হয়। পরে সুস্মিতা অনেক কিছু বলেছিল। প্রশাসন ঠিক থাকলে এমন না হয়ে যায়না।
***************
বাঘসফর। এইগুলোকে বাঘসফর বলা হয়, কারণ, মানুষ এই সব জঙ্গলে বাঘ দেখতে আসেন। আমি দীপঙ্করের দলে ঘোরাঘুরি করি, করেছি অনেক। কিন্তু ‘বাঘসফর’ এ যাইনি কোনওদিন। আমার বাঘে কোনও আগ্রহ নেই। কিন্তু নেই বললে তো হয়না। গতবছর জয়দীপের দলে সুন্দরবন গেছিলাম, মিতালিও গেছিল। এখানে অনেকেই পড়েছেন সেই সচিত্র ভ্রমণবৃত্তান্ত। সুন্দরবনে বাঘ আছে সবাই জানে, গুষ্ঠিশুদ্ধু সবকটা মানুষখেকো বাঘ। কিন্তু সেখানে তো জঙ্গলে ঢোকা যায়না, বাইরে নদি থেকে দেখতে হয়। তা সুন্দরবনের বাঘ দেখা কালেভদ্রে কপালে জোটে হয়ত কারোর। কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে গেল। আর সুন্দরবনের বাঘ দেখার পর অন্য জঙ্গলের ‘নিরামিষ’ বাঘ দেখেও মজা নেই। সেবার সুন্দরবনে আমাদের দলের রুদ্র নামে একজন বাঘের সঙ্গে চোখাচোখি হতে থরথর করে কেঁপেছিল অনেকক্ষণ, হাতের লম্বা জুমওয়ালা ডিএসএলআর হাতেই থেকে গেছিল। আর এক ডাক্তারবাবু বসেছিলে্ন নৌকোর ‘বো’ এর ওপর। তিনিই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন তাকে। তিনি জমে গেছিলেন সেখানে, লিটারালি ফ্রোজেন। এইসব হালকা জঙ্গলে লাল কাঁকরের রাস্তায় বাঘ হেঁটে যায় বেড়ালের মত। দুধার থেকে বিচিত্র রকম বেশভূষা করা নারীপুরুষ ভাড়াকরা ‘জিপসি’ থেকে ক্যাঁচ, ক্যাঁচ, ঠি-ঠি-ঠি-ঠি আওয়াজ করে ছবি তোলেন। আমার কোনও মজা হয়না এতে। কিন্তু এবছর ট্যুরের সঙ্খ্যা কমে যাচ্ছে। নানা কারণে তিনটে গ্রুপের কোনওটাতেই ঠিকমতো সামিল হতে পারিনি। হয়ত সামনের বছর থেকে আর – বয়স তো হল ভালই, বাড়িতে আয়না দেখি আর না দেখি।
তাই ভিড়ে গেলাম চোখ কান বুজে। তাছাড়া জঙ্গল থাকলে পাখি থাকবেই। দেখিনা, কপালে কিছু পাখিও তো থাকতে পারে।
এই ট্যুরে আসার আর এক কারণ তন্ময়-সঞ্চিতা। তন্ময়রা বছরের অর্ধেক থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বহু ট্যুরেই তাদের পাওয়া যায়না। তাছাড়া তন্ময় সঞ্চিতা দুজনেই চেম্বারে বসা ডাক্তার না। তার দুজনেই দুটি সরকারি দপ্তরের শীর্ষে। তন্ময়ের প্যাডে অশোকস্তম্ভ থাকে। তাই তাদের কর্মব্যস্ততার জন্য এই দুজনের সফরসঙ্গী হওয়া ক্রমেই দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। তবু যখনই তাদের পাওয়া যায়, তন্ময়ের গম্ভীর মুখে রসিকতা মিস করা বড়ই লোকসানের। এর সঙ্গে বিপিন। যতই পেছনে লাগি, বিপিন থাকলে একটা অন্যরকম মজা হয়, খুবই ভালমানুষ আসলে। নতুন যে পরিবারটি এল, তার কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বহুদিন আগে ট্রেনে। তখন তাঁরা দীপঙ্করকে চিনতেন না। কিন্তু শুনলাম এঁরাও খুবই আমুদে মানুষ। আমিও ভিড়ে গেলাম।
আমাদের পাতুড়ি খাওয়া শেষ। এখনও অনেক সময় কাটাতে হবে। সাহুজিকে বললাম, শহর সে বাহর কহীঁ লে চলিয়ে, যাঁহা থোড়া হরিয়ালি হ্যায়। ইচ্ছেটা এমন, সময় কাটানোও হবে, দুচারটে পাখি ফাখি জুটে গেলে ভালই। তা তিনি কী বুঝলেন কে জানে, আমাদের নিয়ে এলেন এক লেকের পাড়ে। হ্যাঁ, তার আগে একটা জিনিস দেখাই। নাগপুর শহরটা, দেশের দৈর্ঘ প্রস্থ বিচার করলে একেবারে ভারতের কেন্দ্রে অবস্থিত, সেন্টার অফ ইন্ডিয়া। তাছাড়া সিসমোগ্রাফিকালিও এটি সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তা কেন্দ্রে অবস্থানের দরুণ, সেই বৃটিশ জমানাতেই(স্বাভাবিক) একটি পিলার নির্মিত হয়েছিল, যার নাম ‘জিরো মাইল’। মানে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যেদিকেই যাও, এখান থেকেই ভারত শুরু। এই সেই মাইলফলক।
এখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আমাদের যেখানে আনলেন সাহুজি, জায়গাটা একটা বিশাল
লেক। কোমর সমান পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা প্রেম ট্রেম
করছে, কিছু স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এসে সেলফি তুলছে। কয়েকটি বাচ্চা ছেলে ছিপে করে
টিলাপিয়া মাছ ধরছিল। দীপঙ্কর খুব আগ্রহ পেয়েছে ব্যাপারটায়। সে ওখানে ভিড়ে
গেল। আগেই বলেছি, সাহুজি এখানে গাড়ি চালালেও আদপে ছত্তিসগড়ের। তিনি বললেন
এই লেকটার নাম ‘পুটারা’ লেক। পরে ফেরার সময়ে সুস্মিতার বাড়ি গেছিলাম। সে
দেখলাম আমার ফেসবুক পোস্টের নীচে সংশোধনী দিয়েছে, ‘ফুটালা’ লেক। আমি তাই
এডিট করেও দিলাম। নীচে ফুটালা লেক।
এবার আর নাগপুরের বিশেষ কিছু লেখার নেই। আমরা গেলাম এয়ারপোর্টে। দীপঙ্কর গেল গেস্টদের রিসিভ করতে। প্রথম দফায় আসবে বিপিন, ছোড়দা, আর সুশান্তর পরিবার। এই সুশান্তকে ডাকা হয় ‘সুশো’ বলে। এঁরাও মেজদা ছোড়দাদের জ্ঞাতি, খুড়তুতো দাদা ছোড়দার। সে ন’দা বলে ডাকে। ওদের উড়োজাহাজ অনেক লেটে নামল। ততক্ষণে তন্ময়দের গাড়ি নামার সময় হয়ে এসেছে। সে হাওয়াইগাড়ি আবার আসছে দিল্লী থেকে। এরা সকলে ডিনার করতে গেল। আমাকে দলের প্রায় প্রত্যেকে, বিশেষ করে দীপঙ্কর, বিপিন আর সুশো, বারবার এসে অনুরোধ করতে লাগল কিছু অন্তত খাবার জন্য। আমি বললাম, না। আগে ‘পাতুড়ি’ হজম হোক। এদিকে সাহুজির বিশাল চেহারা। উচ্চতায় নয়, প্রস্থে। তাঁর তো খাওয়া উচিত ওই চেহারার মালিক হিসেবে। তিনিও বুঝেছেন, যা আমাকে খাইয়েছেন(তাও অর্ধেক প্লেট) এবং নিজেও খেয়েছেন, তা কী বস্তু। তাই তিনিও খাবেন না। অন্য গাড়িটিও চলে এসেছে। সেটি চালাচ্ছেন মালিক স্বয়ং, নরেশজি নাম সম্ভবত। সাহুজি অন্য গাড়িটির মালিক।
সবাই মিলে রওয়ানা হলাম তাড়োবার উদ্দেশে। যে রিসর্টটিতে আমদের থাকার জায়গা হয়েছে, তার নাম ‘SVASARA’ । এবার যা পারেন উচ্চারণ করুন। কথা প্রসঙ্গে বলি, আজকাল এই রিসর্টগুলিতে ‘ন্যাচারালিস্ট’ বলে কিছু ছেলেমেয়ে থাকেন। তাঁরা আসলে একটু সফিস্টিকেটেড গাইড কাম ম্যানেজার। এঁরা শিক্ষিত, এঁরা গড়গড়িয়ে ইংরিজি বলতে পারেন, হসপিটালিটির আদব কায়দা জানেন। আবার প্রয়োজনে গেস্ট(বিশেষত বিদেশি)দের সঙ্গে জঙ্গলেও চলে যান। এঁরা পশুপাখি, গাছপালা সম্বন্ধেও পড়াশোনা করেছেন। এঁদেরই একজন বহুকাল ধরে আমার ফেসবুক বন্ধু। অবশ্য গিয়ে তাকে পাইনি, সে তখন কলকাতায়।
আমরা তো গিয়ে পৌঁছেছি রাত্রে। তখন তো আর ছবি তোলা যেতনা। যেত, মানে মোবাইলে না। কারণ আমার মোবাইল অত উন্নত না। আমি বরং সকালে উঠে যে ছবি নিয়েছি তাই দেখাই। নীচে সেই রিসর্টের ‘স্যুট’ গুলোর সম্মুখভাগ। এছাড়াও রিসর্টটি অনেক ছড়ানো, প্রচুর গাছপালা, সুইমিংপুল, পেভ করা রাস্তা, আরও অনেক কিছু। ছবি টবি তুললে হতো সেসবের। যাই হোক, পাথরের পেভিং দিয়ে ভাগ করা আগুপিছু করা কয়েকটি স্যূট দেখা যাচ্ছে। যেটির প্রবেশপথ ঘাসে ঢাকা, সেটি নয়, পরেরটির ভেতরদিকে দুটি স্যুট পাশাপাশি, ১০৫ এবং ১০৬। ১০৫ এ রইলাম ছোড়দা, বিপিন আর আমি, ১০৬ তে তন্ময় সঞ্চিতা। ১১০(এখানে দেখা যাচ্ছেনা)এ রইল সুশো(সুশান্ত),টুটুন(তনুশ্রী) আর জিনা(সোমদত্তা), ওদের মেয়ে।
ঘরের ইন্টিরিয়রটা দেখাই এবার কিছুটা। ঘরগুলো এয়ার কন্ডিশনড, বাথরুম খুব
ভাল, ঘরে ফ্রিজ আছে, ইলেক্ট্রিক কেটল, চা, কফির সরঞ্জাম আছে, বিছানা
আরামপ্রদ, একটা স্টার হোটেলের সব সুবিধাই উপলব্ধ। একটা বড় স্ক্রীনের টিভিও
ছিল, কিন্তু ভাগ্যিস আমাদের কোনও মহিলা নেই, আর ভাগ্যিস পাশের ঘরে সঞ্চিতা
মহিলা হলেও সেই গ্রুপে পড়েনা। তাই শান্তি। আজকাল হোটেল বা রিসর্টের
বিভিন্ন আঙ্গিকের রেটিং হয়। যদি ‘স্লীপ কোয়ালিটি’র রেটিং দিতে আমায় বলা হয়,
তাহলে ***** (ফাইভ স্টারস)
***************
রাত দুপুরে পৌঁছেছি। তারপর ঘর অ্যালট হবে, বাক্স প্যাঁটরা খোলা হবে, রাতের শোবার পোষাক বেরোবে, এই করে শুতে শুতে দেড়টা দুটো। দীপঙ্কর আবার হুমকি দিয়ে গেছে, সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরোতে হবে কিন্তু। কাল সকাল থেকে সাফারি শুরু। মানে বাঘ দেখা আরকি। আমি আবার ভাবছি, শুনেছি এখানে খুব ইন্ডিয়ান পিট্টা পাওয়া যায়। পাওয়া তো যায় আমাদের কলকাতাতেও। কিন্তু বড় জঙ্গলে ফাঁকায় ছবি তুলে আরাম, ভাল শট পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত যতই ক্যামেরাবাজরা চ্যাঁক চুক আওয়াজ করুন, বাই ইনস্টিঙ্কট পাখিরা জেনে যায়, এখানে কেউ আমাদের মারবেনা। সেই খবর জেনেটিকালি ছড়িয়ে পড়ে পরবর্তী প্রজন্মে। তাই অরগানাইজড জঙ্গলে ছবি তোলা আর সাধারণ এলোমেলো জঙলা যায়গায় ছবি তোলায় অনেক পার্থক্য।
শুয়েছি দুটোয়। ট্রেন যাত্রার ধকল ছিল, ‘সাংঘাতিক’(আক্ষরিক) পাতুড়ি খাওয়ার ধকল ছিল, তারওপর সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করতে পথে পথে ৬/৭ ঘন্টা অপেক্ষা করার ধকল ছিল। তাই ‘ঘুমিয়ে কাদা’ বলে বাংলায় যে প্রবচন আছে বাস্তবিক তাই হয়ে ছিলাম। বিছানায় এপাশ ওপাশ করারও সময় পাইনি। পড়েছি আর মরেছি টাইপ। দরজায় দুম দুম ধাক্কা। আমারই ঘুম ভেঙেছে, কারণ আমার ঘুম অল্প শব্দেই ভেঙে যায়। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম চারটে বেজে এগার মিনিট। মানে ওভার এন্থুজিয়াস্টিক রিসর্ট কর্মী কেউ সাত তাড়াতাড়ি জাগিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুজন অচৈতন্য তখনও। অথচ তাদের কিন্তু কোনও ধকলই পোয়াতে হয়নি। তবে এয়ারল্যাগ কি প্রযোজ্য দেড় ঘন্টার ফ্লাইটে? কী জানি। যাই হোক, ভেঙে যখন গেছেই ঘুম, সদ্বব্যবহার করি। কেটলএ জল চাপালাম। দু সেকেন্ডে ফুটে যায়। জল কাপে ঢাললাম, এখানকার কাপ আবার জাম্বো সাইজ। এক কাপ বানালে খেতে আধঘন্টা লাগবে। আমি মাপমতোই বানিয়েছি। খেয়ে দেয়ে সকালের কাজ সেরে এলাম। একবার বিপিনকে একটা ঠেলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এবার আসল চা খাওয়ার বাসনা। ধাক্কা যখন দিয়েছে তখন জেগে আছে নিশয়ই কেউ। কাল দেখে নিয়েছিলাম লাউঞ্জ আর ডাইনিং হল কোনদিকে। ঘাস টাস মাড়িয়ে গেলাম সেখানে। তখনও আলো ফোটেনি ভাল করে।
গিয়ে দেখি চারিদিকে কেউ নেই কোথায় চা পাব তাই ভাবছি, দেখি স্পোর্টস ক্যাপ মাথায় এক যুবক আসছেন গুটিগুটি। বললাম, এক্সকিউজ মি মে আই হ্যাভ সাম টী হিয়ার?
তিনি বললেন, সিওর, শ্যাল আই মেক ইট ফর ইউ? আমি বললাম, নো নো আই ক্যান ডু ইট মাইসেলফ। আই হ্যাভ স্পটেড দা টী ব্যাগস, অ্যান্ড শুগার পাউচেস বাট আই নীড সাম হট ওয়াটার।
তিনি বললেন, ইট ইস কেপ্ট ইন দা ফ্লাস্কস দেয়ার। - ও থ্যাঙ্ক ইউ, মেনি থ্যাঙ্কস, ক্যান আই হ্যাভ সাম বিস্কিটস প্লীজ? (পেট খালি তো)।
তা তিনি ভেতরে গিয়ে প্লেটে করে বেশ কিছু কুকীস নিয়ে এলেন। আবার ধন্যবাদ দিলাম। তখন আলো ফুটেছে। তারপর ভাল করে তাকিয়ে দেখি, ও হরি, এ তো কালকে দেখা সেই ন্যাচারালিস্ট ছেলেটা। প্রসূন বোধহয় নাম। ধুত্তেরি, এতক্ষন ইংরিজি বললাম কেন বেকার? পৃথিবীর যেখানেই থাকি, য’টা ভাষাই জানি, বাংলা বলার মতো সুখ আর আছে?
যাই হোক, এতক্ষণে দীপঙ্কর এসে গেছে। এসেই হম্বিতম্বি শুরু করল, এখনও রেডি হওনি? এখানে আড্ডা মারছ? আমি বললাম দেখ, ম্যালা চিল্লিওনা। আমাকে কি তৈরী দেখছ, না কী? ওদের গিয়ে বলগে যাও। আমি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় চারটে বেজে এগার মিনিটে উঠেছি। জামাকাপড় তো পরেইছি, এই দেখ ক্যামেরাও রেডি। তাই শুনে দীপঙ্কর গেল অন্যদের তাড়া মারতে। আমাদের যখন বেরোনোর কথা, তার বেশ খানিকটা পরেই বেরোলাম কারণ ‘কেউ কেউ’ সকালের কাজ না ‘পেলে’ যেতে পারেন না। অবশ্য দেরিতে বেরিয়ে ক্ষতি কিছু হয়নি। যখন জঙ্গলে ঢুকলাম, তখনও আলো খুবই কম। এদিকে আমি অন্যদের চেয়ে কিছুটা ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজে। দলে দীপঙ্কর আর আমি ছাড়া কেউ ক্যানন-বাহী নন। সকলেরই নিকন। আর নিকন আলো খায় খুব কম। আমি যখন ১৬০০ মারছি, নিকনওয়ালা ৪০০ তে কাজ সারছে। কিন্তু এই মুহূর্তে গিয়ার বদল করা আমার সাধ্যে নেই। আমি ১৯৮০ থেকে ছবি তুলছি অ্যানালগে। ২০১২ অবধি তুলে গেছি। তারপর এই ডিজিটাল যুগে এসে পুরো ভ্যাবচাক। এত পড়াশোনা এই বয়সে করা যায়?
আমরা ঢুকব ‘কোলারা’ গেট দিয়ে। এই তাড়োবার জঙ্গলে আগে বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট (ট্যুরিস্টই বলি, কেন তা পরে বলছি) ঢুকতেন মোহারলি গেট দিয়ে। অনেক রিসর্টও আছে ওই গেটের কাছে। ওখান দিয়ে এখনও মানুষ ঢোকেন। কিন্তু দীপঙ্কর এই রিসর্টের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আসছে অনেক বছর। তাছাড়া এই কোলারা গেট দিয়ে ঢুকলে কয়েকটি বাঘ খুব অল্পসময়ের মধ্যে স্পট করা যায়। মানে, অল্প সময়ে তাদের যেখানে ঘোরাঘুরি করার কথা, সেখানে চলে যাওয়া যায়। তাই এটা অনেকের ফেভারিট। এই জঙ্গলে আরও অনেক ‘গেট’ আছে। সেসব কথা পরে বলব। ভারতের অনেক জঙ্গল যেমন ‘জোন’ হিসেবে ভাগ করা, এই জঙ্গলের ঠিকানা হয় ‘গেট’ দিয়ে।
হ্যাঁ যে কথা বলতে গিয়ে এত বলা, এই যে ‘কোলারা’ গেট দিয়ে ঢোকা, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কয়েকটি বাঘ কে ‘স্পট’ করা, তারপর ছবি তোলা, ভিডিও নেওয়া ইত্যাদি। তেনারাও নাকি ‘হাসিমুখে’ ওবলাইজ করেন। সেই সব বাঘদের আবার নাম আছে। এই নামকরণটা আধুনিক যুগের ফসল। গতবার সুন্দরবন গিয়ে দেখলাম(শুনলাম) সেখানকার বাঘদেরও ‘নাম’ হয়েছে নানারকম। দীর্ঘকাল ও অঞ্চলে কাজ করেছি, জীবনে শুনিনি এসব। বাঘ ইজ বাঘ। কিন্তু এখন দিনকাল পাল্টেছে, এখন প্রতিটি বাঘের নাম মুখস্থ সবার। আর এই জঙ্গলের বা এই গেটের অনতিদূরে যে বাঘ, বা বলা উচিত যে বাঘিনী সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশন, সেই ক্যাট্রিনা কাইফের নাম হচ্ছে ‘মায়া’। বোঝা গেল এখন, এই ট্র্যাভেলগের নাম ‘সবই মায়া’ কেন?
আমরা ঢুকে পড়েছি। এই সফরে কী সব হিসেব আছে, অত জটিল অ্যাকাউন্টিং আমি আর মাথায় ঢোকাইনা। দুখানা করে জিপসি গাড়ি যাবে। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই গাড়ির সওয়ারিদের গ্রুপ পাল্টে যাবে। মানে আজ ক,খ,গ,ঘ, তো কাল ক,খ,ঙ,চ,ঝ – এই সব জটিল জিনিস মাথায় রাখলে আর জঙ্গল ঘোরা হবেনা। আমায় যেটায় উঠতে বলল, উঠে পড়লাম। আজ এটায় সুশোর পরিবার, মানে সুশো, টুটুন, জিনা, তারপর দীপঙ্কর আর আমি। অন্য গাড়িটায় বাকিরা। গাড়িগুলো একই রাস্তায় ঘুরবে তাও না। আমরা একদিকে তো অন্যরা অন্যদিকে। তবে এই ব্যবস্থায় শেষদিন প্রচণ্ড উপকৃত হয়েছিলাম, প্রচণ্ড। পরে বলব সে সব।
আমরা ঢুকেই পেলাম কয়েকটা ‘ঢোল’ কে। ‘ঢোল’ হচ্ছে ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড ডগ। তবে পৃথিবীর অন্যান্য জন্তু, যেমন বাঘ, সিংহ, গুলবাঘ(লেপার্ড), বা হাতি বিভিন্ন দেশে আকারে ও শারীরিক গঠণে সামান্য ভিন্ন হলেও মোটামুটি একই রকম দেখতে। কিন্তু ওয়াইল্ড ডগ বা জঙলি কুকুর আশ্চর্য জীব। আফ্রিকান ওয়াইল্ড ডগ, আমেরিকান কায়োটি, অস্ট্রেলিয়ান ডিঙ্গো আর ইন্ডিয়ান ঢোল প্রত্যেকেই একেবারে আলাদা চেহারার। কারও সঙ্গে কারও কোনও মিলই নেই, একমাত্র কুকুর প্রজাতি বলে বুঝতে পারা ছাড়া। নীচে আমাদের প্রথম দেখা ঢোল। তখনও আলো ফোটেনি ভাল করে।
এর পরে একটা দামি জিনিস পেলাম। থ্যাঙ্কস টু দীপঙ্কর। কারণ আমি এটার পাশে
দাঁড়ানো অন্য পাখি শুট করছিলাম। দীপঙ্করই বলল, ওই দেখ বুশ কোয়েল। ঠিক, তবে
‘বুশ কোয়েইল’ একাধিক আছে, এটা ‘জাঙ্গল বুশ কোয়েইল’। কোয়েইলের ছবি নেওয়া খুব
মুশকিলের। এখানে রাজ্যের ট্যুরিস্ট দেখে লোকসানও যেমন, লাভও তেমন, পাখিরা
ভয় টয় পায়না। তবে বেশির ভাগ ছবিই এসেছে পেছন থেকে। দুটো মাত্র ছবি পাশ ফেরা
আছে। এটা ‘নর’, মানে পুরুষ।
এর পরে আরও দারুণ জিনিস। আমি বনমুরগির ছবি ভীষণ ভালবাসি। বেশির ভাগ যে সব
জায়গায় ঘুরি, সেখানে ‘রেড জাঙ্গলফাউল’ বা লাল বনমুরগির ছবি পাই। এটা ‘গ্রে
জাঙ্গলফাউল’, বা ধূসর বনমুরগি। গোটা দক্ষিণভারত জুড়ে এদের এলাকা। তবে
মধ্যভারতেরও কিছুটা এদে্র। এই জঙ্গলে লাল ভ্যারাইটিটা একদম নেই। যা আছে সবই
গ্রে। যাক একে পেয়ে মন খুব খুশ হল।
***************
‘জঙ্গল জঙ্গল বাত চলি হ্যায় পতা চলা হ্যায়
চাড্ডি পেহেনকে ফুল খিলা হ্যায় ফুল খিলা হ্যায়’
না চাড্ডি ঠিক নয়, তবে অনেক কিছু রঙ বেরঙের ফুল, মানে জীবন্ত ফুল ঘুরছে জঙ্গলে। এখানে মোহারলি গেটের আর কোলারা গেটের আলাদা জিপসি ছাড়াও ‘ক্যান্টার’ নামে এক ধরণের গাড়ি দেখলাম। অনেকটা রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিবন্ধী বা সিনিয়র সিটিজেনের জন্য যে গাড়ি ব্যবহার হয়, সেরকম। তার নাম সত্যিই ‘ক্যান্টার’, না ড্রাইভার গাইডদের ভুল উচ্চারণ তা জানিনা। ‘ক্যান্টার’ হচ্ছে ঘোড়ার এক রকমের চলনের নাম। চারটি চলন হচ্ছে, ওয়ক, ট্রট, ক্যান্টার, গ্যালপ। এ ছাড়া এই শব্দের অন্য অর্থ হয় কিনা জানিনা, হতেও পারে, আমার জানা নেই। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আমার জানা নেই। তবে সেই তথাকথিত ‘ক্যান্টার’ ছাড়া একটা বাসের মত গাড়িও দেখলাম। মাথাখোলা দোতলা বাসে বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের ঘোরানো হয়, এটা মাথাখোলা একতলা বাস। একটি বিশেষ ট্যুরিস্ট রিসর্টে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জন্য উপলব্ধ এই বাসটি, তাঁদের ঘোরানো হয়। এই সব জিপসি, ক্যান্টার ও বাসে চাড্ডি নয়, তবে বিচিত্র সব জিনিস পেহেনকে ফুল খিলে হ্যাঁয়। লাল, গোলাপি, উজ্জ্বল হলুদ – ভারতে এখন সর্বত্র একটাই জিনিষের চাহিদা – ‘রূপাইয়া মাঙতা’। জঙ্গলকে ট্যুরিজমের আওতায় আনতে সব রকম প্রিন্সিপল বিসর্জন দিতে রাজি বনদপ্তর। পয়সা চাই, পয়সা।
মনে পড়ে যায় অনেক পুরনো কথা। ৭০ এর দশক থেকে জঙ্গলে ঘুরছি। তখন জঙ্গলে ঢুকতে গেলে বন দপ্তর বা প্রোজেক্ট টাইগার দপ্তর থেকে পারমিশন করাতে হতো। এবার তাতেই শেষ নয়। সে দপ্তর তো শহরে। এর পরে আসল জঙ্গলের প্রবেশদ্বারে গেলে সেখানে কোনও এক ফরেস্ট অফিসারের কাছে অনেক জেরার উত্তর দিতে হতো, কেন জঙ্গলে এসেছি, কী দেখতে চাই, জন্তু তো চিড়িয়াখানাতেও দেখা যায়, খামোখা জঙ্গলে ঢুকতে চাই কেন, ইত্যাদি। বন দপ্তরের জঙ্গলের ভেতরে থাকা বাংলোগুলো সবই সাহেবি আমলের। তা বুক করাও যেত সহজেই। ভাড়া ছিল ২০/২৫ টাকার মতো। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব জীপ যেত সাফারিতে। তাতে একজন আর্মড গার্ড কাম গাইড থাকতেন। তার জন্য কোনও বাড়তি পয়সা দিতে হতনা। জিপের ভাড়া দীর্ঘকাল ৬০টাকা ছিল, এবার যতজন লোক উঠবেন, তাঁদের মধ্যে ভাড়াটা শেয়ারড হবে। একবার এক মোটা মাড়োয়ারি পরিবারকে তুলব বলে আমরা জবরদস্তি দেরি করিয়েছি। উদ্দেশ্য মাথাপিছু ভাড়াটা আরও কমানো। জীপের ড্রাইভার রেগে চেঁচামেচি শুরু করেছেন। পরে দেখা গেল, দেরিটা করিয়েছিলাম বলে প্রাণে বেঁচে গেলাম জিপের সবাই। ড্রাইভারই দাঁত কেলিয়ে বললেন সেটা। যাক সে গল্প এখানে নয়।
সে সময়ে এক এক জঙ্গলের এক এক নিয়ম। কোথাও দুটো, কোথাও চারটে জীপ পরপর ঢুকবে। তারা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত অন্য কোনও গাড়ি ঢুকবেনা। কোনও কোনও জঙ্গলে নিজের গাড়ি নিয়েই ঢোকা যেত, তবে অনেক রকম পারমিশনের পর। একজন ফরেস্ট গার্ড সঙ্গে যেতেন বন্দুক নিয়ে। কোনও এক্সট্রা পয়সা লাগতনা তাঁর জন্য। কিছু স্পটিং হয়ে গেলে খুশি হয়ে বখশিস দেয়া যেত অবশ্য। ঢোকবার আগে প্রত্যেকের জামা চেক করা হতো। ‘লাল’ রঙ ওয়জ আ স্ট্রিক নো নো। এছাড়াও উজ্জ্বল কমলা, হলুদ, বা ধবধবে সাদা বারণ ছিল। ওঁরা চাইতেন লোক যেন ‘মিলিটারি গ্রীন’ ধরণের রঙের কিছু পরে আসেন। এখনকার মতো আর্মি, বিএসএফ এর জওয়ানরাও তখন ক্যামো ইউনিফর্ম পরতেন না, আর আমরাও সে সব বাজারে কিনতে পেতুম না, যেগুলো অনায়াসেই এখন পাওয়া যায়। মিলিটারি গ্রীন তো সবার থাকেনা, তখন ছাই, গ্রে, কালো, ঘন সবুজ, এই সব পরতে বলতেন। পরিষ্কার মনে আছে, এক কমবয়সি যুবক যুবতী দুজনেই লাল রঙের জামা পরে এসেছিল। তারা ফরেস্ট লজেও ওঠেনি যে গিয়ে পাল্টে আসবে। ছেলেটির জামার ওপর একজন ফরেস্ট গার্ডের পুরনো জামা চাপিয়ে দেওয়া হলো আর মেয়েটির গায়ে একটা চাদর।
আমি নিজে একটা ডেনিমের মিলিটারি গ্রীন কিনেছিলাম, এখনও একদম ভাল অবস্থাতেই আছে। তবে বেশির ভাগ ক্যামো পরেই ঢুকি এখন। কিন্তু ওই ক্যান্টার আর ম্যান্টারে দেখলাম লাল, গোলাপি, হলুদের সমারোহ। সেই ফুল খিলে হ্যাঁয় গুলশন গুলশন টাইপ। আর কেউ কিছু বলেনও না, কোনও নিষেধাজ্ঞাও নেই। একটা মাত্র গেট বাদ গিয়ে অন্যগুলোতে দলে দলে মানুষ ঢুকছেন। কোনও রেস্ট্রিকশন নেই – সবসে বড়া রূপাইয়া। আমাদের সেই সব জঙ্গল ভ্রমণের কথার কিছু কিছু লিখেছি একটা বইতে। তবে নাম বলবনা। বিজ্ঞাপন দিতে রাজি নই। এখন ফরেস্টের গাড়ি যায়না। যা যায়, সবই প্রাইভেট গাড়ি, গাইডও প্রাইভেট। তবে এঁদের ফী যাই হোক, খোদ আমাদের ডুয়ার্সে এই ড্রাইভার আর গাইড(?) এর এন্ট্রি ফী নেয়া হয়। এত বড় জোচ্চুরি আর কোনও রাজ্য করেনা।
চলুন আসল গল্পে ফেরা যাক।
আমি বাঘ দেখতে আসিনি এখানে। তাড়োবার হিস্ট্রিতে একমাত্র ব্যতিক্রমী মানুষ বোধহয়। কিন্তু এসে ভুল করেছি বোঝা গেল। এখানে ফোকাস হচ্ছে বাঘ। ড্রাইভারগুলো উদো। উদো ঠিক নয়, সেয়ানাই, তবে তারাও ফোকাস রেখেই চলে। যেখানে ‘পরশু’ দিন মায়াকে দেখা গেছে, কিংবা যেখানে সে শুয়ে গড়াচ্ছিল সা্ত দিন আগে, সেখানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে পুরো নিষ্ফলা। হয়ত কোথাও সে বিষ্ঠাত্যাগ করেছিল, সেটাও দ্রষ্টব্য। তবে পাখি দেখে রুকো রুকো বলে চেঁচালেও কমপক্ষে পঁচিশগজ দূরে গিয়ে ব্রেকে পা দেয়। তারপর বিকট শব্দে ব্যাক গিয়ার মারে। অত চেঁচামেচিতে আর পাখি থাকে? আমরা তিনদিন ছিলাম ওখানে তিন দিনে পাঁচটা সাফারি তিনটে গেটে। প্রত্যেকবারই আলাদা ড্রাইভার। সবাই এক ধাতুতে গড়া। শেষ দিনে এই এক ড্রাইভারের জন্য অত্যন্ত ঘৃণ্য একটা ব্যাপার হয়ে গেল। ড্রাইভার সিঙ্গল হ্যান্ডেডলি ব্যাপারটা ঘটাল। যথাসময়ে বলব সে কথা।
এ ছাড়াও এ জঙ্গলে দেখলাম গাইড বললে তবে ড্রাইভার দাঁড়াবে, সওয়ারি বললে নয়। আর গাইডও মাত্র কয়েকটি পাখি তার অভিধানে রেখেছে। আমি আগেই বলেছিলাম ‘পিট্টা’র কথা। এখানে পাওয়া যায় ‘ইন্ডিয়ান পিট্টা’। গাইডরা আর চেনে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচারকে, বাংলায় যাকে বলে ‘দুধরাজ’। আসলে এই পাখিগুলো সামার মাইগ্র্যান্ট। বেশির ভাগ পাখিই, যারা মাইগ্রেট করে, অথবা পরিযায়ী হয়, তারা নীচে নামে শীতকালে। বসন্তের শুরুতে বা মাঝামাঝি তারা ফিরে যায় নিজেদের এলাকায়। কিন্তু কয়েকটি পাখি আছে, যারা গ্রীষ্মকালে পরিযায়ী হয়, এদের বলে ‘সামার মাইগ্র্যান্ট’। এই গাইডদের ডিকশনারিতে এদের মধ্যে দুটো পাখি আছে। মানে ট্যুরিস্টরা নেট ফেট দেখে এই দুটোই খোঁজেন। কিন্তু আর একটা সামার মাইগ্র্যান্ট এরা পাত্তাই দেয়না। একেবারে খোলা জায়গায় ছবি তোলার জন্য আইডিয়াল পোজিশনে বসে ছিল জ্যাকোবিন কুকু। এদের ডিকশনারিতে নেই, তাই থামেনি। আমি বিপুল চেঁচামেচি করে গাড়ি ‘ভীষণ’ ভাবে ব্যাক করাতে গেলে সে উড়ে গেল। লাঞ্চে ফেরার সময়ে দেখলাম রিসর্টের বাগানেই একজন ঘুরছে। সুশো বলল, দাদা এইতো, এখানেই আছে। পরে তুলে নিলেই হবে। কিন্তু রিসর্টের ভেতরে ছবি তোলার সময় পেলে তো।
অগত্যা সেই ‘পিট্টা’। গাইড কিন্তু পিট্টা দেখলেই দাঁড়াচ্ছে। এটা হট প্রপার্টি বোধহয়। হূই দূরে, যেখানে জুম করে, ক্রপ করে, হাজার চেষ্টাতেও কোনও ছবি করা যাবেনা, সেখানেও দাঁড়াচ্ছে। যাই হোক দূরের গুলো আমি তুলিই নি। একটাকে পেলাম বেশ কাছেই, বেশ সুবিধেমতো যায়গায়। এই যে সেটা। মলাটেও আজ তিনিই।
পিট্টা পাওয়া গেল। অবশ্য পেছন থেকে। তাই পেটের নীচের দিকের লাল রঙটা দেখানো গেলনা। এমতাবস্থায় কেউ আমাকে বলতেই পারে, আপনি তো পিট্টা পিট্টা করছিলেন, ব্যস হয়ে গেল পিট্টা, খেল খতম, প্যায়সা হজম। তা ঠিকই। কিন্তু জঙ্গলে দুরাত্তির একবেলা থাকব, শুধু পিট্টা দিয়ে পেট ভরাব? আমি কিন্তু বাঘের কথা ভাবছিই না। আগে লোকমুখে শুনতাম তাড়োবায় বাঘ বেড়ালের মতো ঘুরে বেড়ায়। আমার দলের অধিকাংশ সদস্য বহুবার তাদের দেখেছে। কোনটা মায়া আর কোনটা ম- সরি ইয়ে আরকি, এক মাইল দূর থেকে দেখেই বলে দেবে। আমি কিন্তু পারবনা। যদিও হাইপথিটিকালি জানি প্র্তিটি বাঘের গায়ের স্ট্রাইপ বা ডোরা আলাদা, মানুষের বুড়ো আঙুলের দাগের মতই। যাক গে, আমার আফশোস বহু পাখি চোখের সামনে দিয়ে ফসকে গেল। ড্রাইভার হতচ্ছাড়া তুলতেই দিলনা।
আসামে প্রথমবার ঠিক এমনই হয়েছিল। ওখানে গাইড কম্পালসরি ছিলনা। শুধু ড্রাইভার। এখানে যেমন বাঘ ওরিয়েন্টেড, ওখানে গণ্ডার। আসামিজরা বলেন ‘গঁর’। একটা বেলা নষ্ট হওয়ার পর আমি ড্রাইভারকে অমুল্য কে বললাম দেখ বাপ, আমি গণ্ডারের ছবি নেবনা। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেও নেবনা(যদিও নিয়েছিলাম)। তুই আমাকে পাখি দেখে গাড়ি না থামাস তো আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা হাঁটা দেব। তোরই লাইসেন্স যাবে। তখন ব্যাটা বুঝে গেল ব্যাপারস্যাপার। এখানে সে সব প্রশ্ন নেই। কয়েকবার রুকো রুকো করে আমিও চেপে গেলাম। যা বাবা কোথায় নিয়ে যাবি চল।
এর পরের পাখিটা কোনও পাখিই নয়, সারা ভারতে যে কোনও জায়গায় পাওয়া যায়। কলকাতার আসেপাশেও আছে। এর নাম ‘ওরিয়েন্টার হোয়াইট আই’। কী আর করা কিছু না পেয়ে একেই নিলাম।
এর পরের পাখিটা ইন্টারেস্টিং বটে। গাইডেরও কী দয়া হল থামাল। সেই দেখাল। এর
নাম ‘থিক নী’ বা ‘হাঁটু ফোলা’(না এটা বাংলা নাম নয়)। বেশ কয়েক রকম থিক নী
পাওয়া যায় ভারতে। এটা সব চেয়ে কমন। এর নাম ‘ইন্ডিয়ান থিক নী’।
এর পরের পাখিটাও সর্বত্র দেখা যায় প্রায় কাক চড়াইয়ের মতো। ‘হাট্টিমাটিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম’- সেই হট্টিমা বা সংস্কৃত ‘টিট্টিভ’। ইনি ‘হট্টিমা’, হাট্টিমা নন। ওটা কবির লাইসেন্স।বাংলার কোথাও কোথাও ‘হট্টিটি’ ও বলা হয়। ইংরিজি নাম ‘রেড ওয়্যাটলড ল্যাপউইঙ’। একে কয়েক হাজার বার দেখেছি, তবে তাড়োবায় এসে প্রথম একে মাঠে বসে ডিমে তা দিতে দেখলাম। আর এখানেই প্রথম এর ছানা দেখলাম। সে সব দেখাব পরে। এর ছবি নেয়ার উদ্দেশ্য ছায়াটাকে তোলা। তাও দীপঙ্কর বলল বলে নিলাম।
***************
এই পর্বে, ‘পড়েছি আতান্তরে’ বলে একটা কথা আছে না, আমার সেই অবস্থা। এমন কিছু লিখতে হবে, যা আমি ‘ধাঁই’ করে লিখেই ফেলতাম আন্ডার অর্ডিনারি সারকামস্ট্যান্সেস। এখন পড়েছি সেই ‘আতান্তরে’। এই ফেসিলিটিটি যিনি ‘ম্যানেজ’ করেন, এবং অতি সুষ্ঠভাবে করেন আদারওয়াইজ, সেই রঞ্জিতবাবু, মানে শ্রী রঞ্জিত মণ্ডল আমার ফেন্ডলিস্টে এসে হাজির। কাজে কাজেই এখন বলতে হবে রেখে ঢেকে। তবে মূল বক্তব্য একই থাকবে পাঠক নিশ্চিন্ত থাকুন। যা যা ভাল বলার, আমি বলেছি মন খুলে। যা খারাপ লেগেছে, তা বলতেই হবে। তবে হ্যাঁ, উনি নিজেই একবার কথাপ্রসঙ্গে খুবই ভদ্রভাবে পেশ করলেন, যে – আচ্ছা থাক, যে হবে সময়মতো। চলুন জঙ্গলে ঘুরে আসি।
জঙ্গলে যতই বাঘ দেখুন আর সিংহ দেখুন, ‘জঙ্গল’ দেখার একটা আলাদা স্বাদ আছে। তবে একটা আশ্চর্য ব্যাপার, জঙ্গলের ছবি কখনই ঠিকঠাক তোলা যায়না। এ আমি দেখছি সেই আশি সাল থেকে, যখন আমি ফোটোগ্রাফি শুরু করি। তার আগে জঙ্গলে ঢুকতাম খালি হাতে – ‘টেক নাথিং বাট ফোটোগ্রাফস, লীভ নাথিং বাট ফুটপ্রিন্টস’ – যে বলা হয়, তার কোনওটাই জঙ্গলে ফিট করাতে পারিনি। ফুটপ্রিন্টসের প্রশ্ন নেই, অধিকাংশ জঙ্গলে পায়ে হাঁটা মানা। আর ফোটোগ্রাফ যে নেব, তখন তেমন ভাল ক্যামেরাও ছিলনা। ‘ভাল’ ক্যামেরা আর আড়াইমণি জুম কেনার পর প্রথম গেছি বান্ধবগঢ় আর তার পর গেছি করবেট ন্যাশনাল পার্ক। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই। অপূর্ব সেই সব জঙ্গলের ছবি মনক্যামেরায় ধরা আছে, যান্ত্রিক ক্যামেরা তা তুলতে পারেনি।
এখানে দেখুন, মলাটে জঙ্গলের একটা ছবি দিয়েছি। এটা কোনও ছবিই নয়। বাস্তবে চোখে যা দেখেছি, এত বছর ছবি তুলেও তা কাউকে দেখাতে পারিনি। কিন্তু পাহাড় বা সমুদ্র, চোখে যা দেখছি তার চেয়ে অনেক রূপবান করে প্রেজেন্ট করা যায় ফোটোগ্রাফে। এইজন্যই ‘জঙ্গল’ স্কোরস ওভার অল আদার্স।
কিন্তু আমার সস্তা স্মার্টফোনে যে ছবিটা উঠল, তা বরং অনেক কাছাকাছি। দিলাম।
আজ প্রথমে যার ছবি তুলেছি, তার ছবি কেউ তোলেনা জঙ্গলে। তবে লেজটা সোজা ঝুলছে, এমন দৃশ্য বেশ মজা্র, তাই নিলাম। যদি ব্লো আপ করে দেখাতাম, মুখের এক্সপ্রেশনও দারুণ ছিল। তবে অন্য অনেক ছবি দেওয়ার আছে, এটা ছোটই থাক।
এর পরে দেখাব ঢোলের প্রেম। অনেক রকম ঢোল পেয়েছি এবার, কিন্তু রাধাকেষ্ট ঢোল প্রথম দেখলাম এবং ছবি তুললাম। যতই হিংস্র প্রাণী হোক, প্রেমে সে
কুপোকাত।
কুপোকাত।
বাঘের চোখ সরাসরি দেখছেন কখনও? না তাড়োবার বাঘ না, মানুষখেকো বাঘ। আমরা কিছুদিন আগেই দেখেছি সুন্দরবনে। তাতে কার কী রিঅ্যাকশন হয়েছিল, লিখেছি আগের কোনও পর্বে। এবার কাছ থেকে, সমুখ থেকে, দেখুন ঢোলের চোখ। ঢোল হচ্ছে নৃশংসতম প্রাণী। আর সব কারনিভোর, মানে বাঘ, সিংহ, গুলবাঘ(লেপার্ড) এনমকি চিতাও শ্বাসনালী বন্ধ করে মারে। তারপর খায়। যখন সে পশুটিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তখন সে টেরও পাচ্ছেনা, কারণ সে ইতোমধ্যে মৃত। কিন্তু একমাত্র ঢোল জ্যান্ত খায়
ভিকটিমকে, আবার খায় শেষের দিক বা পেছন দিক থেকে। মানে যখন তার বুকের খাঁচা তারা খুলে ফেলেছে, তখনও শ্বাস পড়ছে, হৃদয় ধুকপুক করছে। এতই হৃদয় বিদারক সে দৃশ্য, যে কর্ণাট দেশের বন্দিপুরে একবার আমাদের থাকাকালীন ঢোলদের একটা গর্ভিনী হরিণীকে খাওয়ার দৃশ্য দেখতে না পেরে রেঞ্জারসাহেব বন্দুক বের করে চারটে ঢোলকে গুলি করে মারেন। যদিও জঙ্গলের আইনে তা অপরাধ। ফরেস্ট গার্ড ও অন্যান্যরা ব্যাপারটা চেপে গেছিল, কেউ সাক্ষ্য দেয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।
ভিকটিমকে, আবার খায় শেষের দিক বা পেছন দিক থেকে। মানে যখন তার বুকের খাঁচা তারা খুলে ফেলেছে, তখনও শ্বাস পড়ছে, হৃদয় ধুকপুক করছে। এতই হৃদয় বিদারক সে দৃশ্য, যে কর্ণাট দেশের বন্দিপুরে একবার আমাদের থাকাকালীন ঢোলদের একটা গর্ভিনী হরিণীকে খাওয়ার দৃশ্য দেখতে না পেরে রেঞ্জারসাহেব বন্দুক বের করে চারটে ঢোলকে গুলি করে মারেন। যদিও জঙ্গলের আইনে তা অপরাধ। ফরেস্ট গার্ড ও অন্যান্যরা ব্যাপারটা চেপে গেছিল, কেউ সাক্ষ্য দেয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।
এ জঙ্গলে শুনেছি তারা ‘মায়া’র কয়েকটা বাচ্চাকে খেয়ে ফেলেছিল বলে মায়া তাদের চুন চুন কে মারে। এ কারণেই নাকি মাত্র পাঁচটা ঢোল এখন এই এলাকায়। তবে এটা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ অন্যান্য জঙ্গলে বাঘ রীতিমতো ভয় পায় এদের। এরা তো দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণ করে চারদিক থেকে ঘিরে। কজনকে মারবে? একটা ঢোলের ফ্রন্টাল ক্লোজ আপ দিলাম। দেখুন চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় কিনা।
এর পরের যে পাখি দেখাচ্ছি, তার নাম ‘ব্ল্যাক আইবিস’ বা ‘রেড নেপড আইবিস’। ‘নেপ’ মানে গলার পেছন দিক।
এদের মাথা ও গলার পেছনটা লাল হয়, তাই এই নাম। আমি অনেকবার রেড নেপড আইবিসের ছবি পেয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। একবার তো বিরাজ(মুখার্জি) এর হাসিমারায় গিয়ে দলে দলে ব্ল্যাক আইবিস দেখলাম। কিন্তু একেবারে ভোর বেলাতেই এত কড়া সূর্য্যালোক, যে ছবি ঠিকমতো এক্সপোজ হলনা। এখানে মোটামুটি হয়েছে। কালো পাখির ছবি নেওয়া। মানে ঠিক এক্সপোজারে ছবি নেওয়া কিন্তু যথেষ্ট চাপের।
এদের মাথা ও গলার পেছনটা লাল হয়, তাই এই নাম। আমি অনেকবার রেড নেপড আইবিসের ছবি পেয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। একবার তো বিরাজ(মুখার্জি) এর হাসিমারায় গিয়ে দলে দলে ব্ল্যাক আইবিস দেখলাম। কিন্তু একেবারে ভোর বেলাতেই এত কড়া সূর্য্যালোক, যে ছবি ঠিকমতো এক্সপোজ হলনা। এখানে মোটামুটি হয়েছে। কালো পাখির ছবি নেওয়া। মানে ঠিক এক্সপোজারে ছবি নেওয়া কিন্তু যথেষ্ট চাপের।
আজকের শেষ পাখিটা খুবই কমন। সব জঙ্গলে আর কাউকে না পান, একে পাবেনই। কিন্তু এত কাছে একে এই প্রথম পেলাম। তাই প্রোফাইল তুলে দেখাই। পাখিটা গাইড স্পট করেনি, করেছে দীপঙ্কর। খুব কাছে বসেছিল। সম্ভবত চান করে ডানা শুকোচ্ছিল পুকুরপাড়ে একটা পাথরের ওপর বসে। আমি ফুল ফিগার দেখাচ্ছিনা, অনেক পাবেন পরে। খালি থোবড়া টা দেখুন। এর নাম ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল। নামে ক্রেস্টেড হলেও এর ফোলানো ‘ক্রেস্ট’ বা ঝুঁটি দেখা
ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ সময়ে সেটি সে গুটিয়েই রাখে এর ছবি আমার প্রচুর আছে, কেননা ইনি খুবই সহজলভ্য। কিন্তু এত কাছে এই প্রথম পেলাম। তবে যত রকম ঈগল আছে, তাদের মধ্য অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ইনি উড়ন্ত অবস্থায়। আবার আরও এক মজা, এর গায়ে কোথাও সবুজের লেশমাত্র নেই, তবে উড়ন্ত অবস্থায় এর হামেশাই ‘সবুজ’ রঙের ছবি তোলেন ফোটোগ্রাফাররা। তাই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক, কালার কারেকশন নিয়ে চাপাচাপি, ইত্যাদি হয়। তবে আমার ধারণা ছবির দোষ নয়, আকাশ যে কারণে ‘নীল’ লাগে, তেমনই কোনও রিফ্র্যাকশন জনিত কারণ আছে এর পেছনে। যাক অনেক বকবক করার পর, সেই ছবি।
ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ সময়ে সেটি সে গুটিয়েই রাখে এর ছবি আমার প্রচুর আছে, কেননা ইনি খুবই সহজলভ্য। কিন্তু এত কাছে এই প্রথম পেলাম। তবে যত রকম ঈগল আছে, তাদের মধ্য অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ইনি উড়ন্ত অবস্থায়। আবার আরও এক মজা, এর গায়ে কোথাও সবুজের লেশমাত্র নেই, তবে উড়ন্ত অবস্থায় এর হামেশাই ‘সবুজ’ রঙের ছবি তোলেন ফোটোগ্রাফাররা। তাই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক, কালার কারেকশন নিয়ে চাপাচাপি, ইত্যাদি হয়। তবে আমার ধারণা ছবির দোষ নয়, আকাশ যে কারণে ‘নীল’ লাগে, তেমনই কোনও রিফ্র্যাকশন জনিত কারণ আছে এর পেছনে। যাক অনেক বকবক করার পর, সেই ছবি।
এবার আমরা যাক ব্রেকফাস্ট করতে। রিসর্ট কর্তৃপক্ষ প্রচুর খাবারদাবার গাড়িতে তুলে দেন ব্রেকফাস্টের জন্য সেকথা বলছি, তবে একটা ছবি দেখিয়ে নিই আমাদের গাড়ির। সামনের সীটে সুশো, জিনা আর টুটুন, পেছনে দীপঙ্কর আর অধম।
ব্রেকফাস্টে থাকে ক্যাসারোলে ভরা পোহা বা উপমা, স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ, কলা, প্লাম কেক, চা, বিস্কিট, সফট ড্রিঙ্ক, ফ্লাস্কে ভরা শীতল জল, এলাহি ব্যাপার। নিজেরা খেয়ে, ড্রাইভার গাইডদের খাইয়েও অনেক বেশি থাকে। কিন্তু – আচ্ছা কিন্তুটা পরের দিন। দেখুন দীপঙ্করের
হাসিমুখ, মানে বিজয়ীর হাসি। অন্য ছবিতে খাবার দাবার গুলো দেখানো যেত, কিন্তু এই ‘বিজয়ীর হাসি’ পাওয়া যেতনা, তাই এই ছবি নির্বাচিত হইল।
হাসিমুখ, মানে বিজয়ীর হাসি। অন্য ছবিতে খাবার দাবার গুলো দেখানো যেত, কিন্তু এই ‘বিজয়ীর হাসি’ পাওয়া যেতনা, তাই এই ছবি নির্বাচিত হইল।
ব্রেকফাস্ট টা খাওয়া হয় মোটামুটি ট্যুরের মাঝামাঝি। মানে সকাল সাড়ে পাঁচটায় গিয়ে গেটে অন্য ‘জিপসি’দের আগে বা পরে লাইন লাগালেও ঢুকতে পাওয়া যায় ঠিক ছটায়। সাফারির সময় এগারোটায় শেষ। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মে এগারোটা অবধি কেউই ঘুরতে পারেন না। মোটামুটি দশটাতেই ফিরে আসেন সবাই খুব দেরি হলে। অনেকে তারও আগে ফেরেন। আমাদের তাড়োবা ভ্রমণে কিন্তু লাভ লোকসান দুটোই হয়েছে। কিছুদিন আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায়, গাছ গাছালিতে পাতা বেরিয়ে গেছে। এটা লোকসান, কারণ দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে অল্প দূরত্বেই, পেছনে কী আছে যেখা যাবেনা বা দেখা গেলেও ছবি নেওয়া যাবেনা। আর লাভ হয়েছে এটাই, যে আমরা এগারোটা না হলেও প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত জঙ্গলে থাকতে পেরেছি। পাতা বেরোবার কারণে না কপাল খারা্পের দরুণ জানিনা, আমরা ‘মায়া’র মমতা থেকে বঞ্চিত হলাম। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। কিন্তু আমরা পাইনি বলে আর কেউ পাননি তা নয়। অমুক জিপসি অমুক জায়গায় তাকে চকিতে একবার দেখেছে, তমুক জিপসি ঢোকবার আগেই তিনি নিতম্ব প্রদর্শন করেছেন, ইত্যাদি। ফর দ্যাট ম্যাটার, বাঘের নিতম্ব মোটেই দৃষ্টিসুখকর নয়, সে বাঘিনী হলেও। যাই হোক অনেক ঘোরাঘুরি হলো, লাভ কিছুই হলনা। আমি দীর্ঘকাল বাঘের জঙ্গলে ঢুকিনি। সব জঙ্গলে বাঘ আবার এত ‘ফ্রেন্ডলি’ নয়। ধরা যাক কাজিরাঙা, সেখানে মোট বাঘের সংখ্যা এখানের থেকে অনেক বেশি। ম্যাক্সিমাম কনসেন্ট্রেশন কোহরা আত অঘোরাতোলি রেঞ্জ এ। আমি অনেক বার গেছি সেখানে। কোনওবারই বাঘ দেখিনি। বাঘ যাদের ধরে খায়, তারা এত নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করে, যে মনেই হয়না এ জঙ্গলে একটা বাঘও আছে। বাঘ না দেখতে পাওয়ার আফশোসও আমার নেই। আমি যে কারনে যাই, সে সব পেয়েই আমি খুশি।
মহারাষ্ট্রের বাঘরা কিন্তু অনেক ‘ফ্রেন্ডলি’, বিশেষত শেষ দিনে যে সব ইতর মানুষ দেখলাম, তাদের চেয়ে অনেক ফ্রেন্ডলি। সে সব কথায় আসছি পরে।
আগেই বলেছি পাখিদের মধ্যে সামার মাইগ্র্যান্টদের এই সময়ে পাওয়া যায়, প্রধাণত ইন্ডিয়ান পিট্টা, এসিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার আর জ্যাকোবিন কুকু। আমাদের গাইড ও ড্রাইভারদের ডিকশনারিতে জ্যাকোবিনের নাম নেই। তাই তাঁরা ইন্টারেস্টেড নন। অন্তত বার তিনেক জ্যাকোবিন কুকু দেখে থামতে বললেও তাঁরা থামেননি। একবার তো দারুণ সুন্দর পার্চে বসেছিল। খুব ভাল ছবি হতো। এই আমরা, পাখিবাজরা, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরি কত আর নতুন পাখি পাই, সবই তো থোড়বড়িখাড়া। তবে এত উৎসাহ কেন? তার কারণ কখন যে পার্চ কেমন পাব, কেমন ব্যাকগ্রাউন্ড থাকবে, আলো কেমন, এমনই অনেক ফ্যাকটর কাজ করে। ঠি-ঠি-ঠি-ঠি করে যত শাটারই মারি, সারা টুরে বলার মত ছবি হয় এক আধখানা।
যাই হোক পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ইন্ডিয়ান কুকু অথবা কমন কুকু, এদের বাংলা নাম ‘পাপিয়া’। এই গোত্রের সব পাখিই সারোগেট পেরেন্ট খোঁজে। এরা কেউ নিজে বাসা বানায়ওনা, ডিমও পাড়েনা। কোকিল বাসা খোঁজের কাকের, সেইজন্য কামোফ্লেজ কালো রঙের শরীর। পাপিয়া ডিম পাড়ে ছাতারের বাসায়। কোকিল যেভাবে কাককে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, পাপিয়ার সে টেকনিক নয়। সে ক্যামো নেয় শিকরা পাখির, যারা অন্য পাখি শিকার করে। পাপিয়াকে দেখতে অনেকটাই শিকরার মতো। ছাতারে দূর থেকে তাকে দেখে শিকরা ভাবে, বাসা ছেড়ে ভয়ে পালায়। তখন পাপিয়া গিন্নি সেখানে ডিম ছেড়ে আসেন। এদিকে জ্যাকোবিন কুকু ক্যামোফ্লেজ নেয় বুলবুলির। তারা বুলবুলিকে ভুলিয়ে বের করে তার বাসাতেই ডিম রেখে আসে। একে দেখতেও অনেকটা বুলবুলির মত, মাথায় ঝুঁটিও আছে, তবে বুকের কাছটা সাদা। এই জ্যাকোবিন কুকু বা ইন্ডিয়ান পায়েড কুকু কে বাংলায় বলে ‘চোখ গেল’। অনেকেরই ধারণা ‘পাপিয়া’ আর ‘চোখ গেল’ একই পাখি। আসলে তা নয়, তবে এরা একই গোত্রের পাখি। আনফরচুনেটলি জ্যাকোবিনের ছবি দেখাতে পারলামনা। নেটে দেখে নেবেন।
সামার মাইগ্র্যান্টদের অন্য আর একটি পাখি হচ্ছে এসিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার বা বাংলায় ‘দুধরাজ’। এরা আবার উল্টো মাইগ্রেশন করে। মানে নীচ থেকে ওপরে। এরা আদপে তামিলনাড, কেরালা ও শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা। এরা সামারে বা গ্রীষ্মে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহারাষ্ট্রের মত অত্যধিক গরম জায়গাতেও যেমন যায়, আবার হিমালয় সংলগ্ন হিমাচল, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপূর্বের রাজ্যেও চলে যায়। আমি সিকিমের ‘উত্তরে’ তেও পেয়েছি একে। কেন সে একই সঙ্গে ঠাণ্ডা আর গরম জায়গায় একই ঋতুতে মাইগ্রেট করে, তা বড়ই বিচিত্র। ‘ওবেলিক্স’ এখানে থাকলে বলত ‘দীজ এসিয়ান প্যারাডাই ফ্লাইক্যাচারস আর ক্রেজি’।
কেন ইনি স্বর্গের বাসিন্দা? মানে ‘প্যারাডাইস’ শব্দটা কেন? আসলে নিউগিনির ‘বার্ডস অফ প্যারাডাইসদের’ নেটে নিশ্চয় অনেকেই দেখেছেন। অপূর্ব বর্ণিল তাদের শরীর আর তাদের অনেকেরই শরীরের থেকে লেজটি বিরাট লম্বা। সেই থেক লেজ লম্বা পাখি যত আছে দুনিয়ায়, সকলেরই নাম হয়ে গেল ‘প্যারাডাইস’ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে এক ধরণের কিংফিশার বা মাছরাঙা পাওয়া যায়, যা অবিকল আমাদের অতি সহজলভ্য হোয়াইট ব্রেস্টেড কিংফিশারের মত দেখতে। শুধু ব্রীডিং সীজনে তাদের পুরুষদের, শরীরের কোনও রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন দুটো ফিতের মত লম্বা সাদা রঙের পালক গজায়। অমনি তাদের নাম হয়ে গেল, ‘প্যারাডাইস কিংফিশার’।
তা এই এসিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচারের স্ত্রীটি কমলা রঙের ও পুরুষটি সাদা রঙের হয়। মাথা কালো ও চোখে নীল রঙের বৃত্ত থাকে। আর পুরুষদের থাকে বিশাল লম্বা লেজ। তাই এদের নামের সঙ্গে ‘প্যারাডাইস’ জুড়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু পুরুষ কমলা রঙেরও হয়, মানে স্ত্রী পাখিটির মতো। তাদের বলে রুফাস মর্ফড মেল। এবার কিন্তু তাড়োবায় কমলা পুরুষই অনেক দেখলাম। আমি সাদা দুধরাজের ছবি নিতে পারিনি। আমাদের অন্য গাড়িতে যারা ছিল পেয়েছে। এটি স্ত্রী দুধরাজ, তাই লম্বা লেজ নেই।
এক জায়গায় হরিণ চরছিল অনেক, মানে চিতল হরিণ। তার মানে ধারে কাছে বাঘের কোনও গল্প নেই। চিতলের ছবি এমনি কেউ নেয়না,
তবে ধাড়ি পুরুষটার শিঙটা বেশ ফোটোজেনিক।
শুয়োর দেখলাম একপাল। ওয়াইল্ড বোরস,
বুনো শুয়োর। কেন জানিনা ঈশ্বর(বা ডারউইন) এ
বেচারাদের এত কুৎ্সিত করে বানিয়েছেন।
আমরা ব্রেকফাস্টের পর মায়ার জন্য
প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় দিন কাটালাম। মানে অর্ধেক দিন। সেকেন্ড হাফটা পড়ে আছে দেখা যাক। এবার আমরা যাব লাঞ্চ
করতে। সেই অপ্রিয় ব্যাপারটা আবার লিখতে হবে।
থাকগে, কাল হবেখন।
এই দেখুন এই রিসর্টের ডাইনিং লাউঞ্জের ছবি। ছবিটা দেখুন। এর পরে আরও ছবি দেব। এঁদের দুটি লাউঞ্জ আছে, একটি লাঞ্চের জন্য ও সম্পূর্ণ পৃথক জায়গায় অন্যটি ডিনারের জন্য। সেগুলির সব কটিরই ছবি দেব। দুটি লাউঞ্জই খুব যত্ন নিয়ে, নামি কোনও আর্কিটেক্টকে দিয়ে বানানো হয়েছে। আমার অনেক নামিদামি রিসর্টে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছে এর পূর্বে। তবে অঙ্গসজ্জায় এতটা রুচির ছাপ কোথাও চোখে পড়েনি। আমি আলাদাভাবে সেগুলি সবই দেখাব। ডাইনিং এরিয়াটার বেশি ছবি তোলা হয়নি, তবে লাঞ্চিয়ন লাউঞ্জটা অনেকটাই দেখাব পরের দিকে। মুগ্ধ হওয়ার মতই।কিন্তু, ওই ‘ভানুমতীর হাঁটু’ (যাঁরা এই বহুল পঠিত গল্পটা জানেন না, তাঁদের জন্য আমি দুঃখিত)। ছবিতে লাউঞ্জের মাঝামাঝি দুটি থাম দেখেতে পাচ্ছেন? এবার যে থামটির সামনে রাখা ছোট কাঠের কাউন্টারটি দেখতে পাচ্ছেন, তার ওপর রাখা রয়েছে ‘ডেসার্ট’ এটি ডেসার্ট কাউন্টার। এর ঠিক উল্টোদিকে অন্য একটি থাম দেখা যাচ্ছে। সেখানেও অনুরূপ আর একটি কাউন্টার আছে, যেটি এই ছবিতে দৃশ্যমান নয়, সেখানে থাকে ‘আমিষ’ পদ, একটি। আসল কথা, ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর বন্ধুদের আবদার ওঠে ট্র্যাভেলগ লেখার। এই করে করে ৮০ ভাগ ট্যুরেরই ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখে হয়ে যায়। তবু ট্যুরের সময়ে তা খেয়াল করে ছবি তুলিনা। নইলে সবগুলিই আলাদা করে দেখানো যেত। প্রায় তিন দিন ছিলাম তো ওখানে।
যা বলছিলাম, ডেসার্ট কাউন্টার আলাদা জায়গায় থাকে অনেক রিসর্টেই। কিন্তু কোথাও হয়ত এলাকা বিশেষে আমিষ হয়ই না। কিন্তু যেখানে হয়, সেখানে তাকে মেন টেবল থেকে দূরে সরিয়ে আলাদা করার অর্থ বুঝিনি। তার কারণ এখন আগের মতো ‘বাঙালি’ ওরিয়েন্টেড ট্যুর আর নেই। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই স্থানীয় মানুষজন খুব বাইরে যাচ্ছেন, জঙ্গলেও ঢুকছেন খুব। মানে যবে থেকে জঙ্গলটাও ‘ট্যুরিজমে’ ঢুকে পড়েছে অর্থাগমের নিমিত্ত, তবে থেকে। তাই এখানে মারাঠিরাও খুবই আসেন দেখলাম। মহারাষ্ট্রে দক্ষিণি ইনফ্লুয়েন্স বেশি, তাই চিন্তাধারাতেও সেই ছাপ। দক্ষিণের অনেক গোঁড়া বামুনকেও দেখেছি ‘ডিম’ খেতে। তাঁদের বক্তব্য, যেহেতু পোল্ট্রির ডিম নন-ফার্টিলাইজড, অতএব সেটি ‘ভেজ’ আইটেম। এখানেও মেন কাউন্টারে অন্য সব আইটেমের পাশাপাশি ডিমের কারি থাকছে, যেদিন হয়। তবে মুরগি বা মাংসকে দূরে সরিয়া রাখা হয়েছে ছুতমার্গের কারণে। কিন্তু মারাঠিদের মধ্যে একমাত্র ‘বৈদিক ব্রাহ্মণ’ ছাড়া অন্য জাতিরা মাছমাংস খান। এমনকি ‘সারস্বত ব্রাহ্মণ’(শচীন তেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়)রাও খান। তাহলে এখানে শুধুই কি লোকাল বৈদিক বামুনরাই আসেন? কে জানে।
তবে হে পাঠক, আপনাদের একটি ‘সুঝাও’ – এখানে এলে খুব আরামে থাকবেন। দারুণ ঘুরবেন। কিন্তু দয়া করে সাব-কাউন্টার দুটোর ওপরে রাখা আইটেমগুলি, মানে, ‘নন-ভেজ’ আর ‘ডেসার্ট’ খাবেন না। আমি এইটুকুই এখন বলতে পারব। তার বেশি নয়। রঞ্জিতবাবুরা আছেন। তবে আমার অভিমত একান্তই ‘আমার’, তা উনি বলেওছিলেন একদিন বাক্যালাপে। দীপঙ্করও মোটামুটি নিউট্রাল স্ট্যান্ড নিয়েছিল। তার যা পেশা, তাতে তাই স্বাভাবিক। আমার কপাল খারাপ তন্ময় কাছাকাছি ছিলনা। হ্যাঁ ভেজ আইটেম সংখ্যায় অনেক আর দিব্যি খেতে, প্রায় সবগুলোই। সেগুলোই খান না।
এবার চলুন দ্বিতীয় ভাগে জঙ্গলে ঢুকি। ঢুকতেই একেবারে সামনে চলে এল এক দৃশ্য – একটি প্যারাডাইস ফ্ল্যাইক্যাচারের বাসা। আমাদের বার্ডিং কমিউনিটিতে, পাখির বাসার, ডিমের বা উড়তে শেখেনি এমন বাচ্চার ছবি তোলা কঠোর ভাবে নিষেধ। তার কারণ অতি সরল। প্রথমত, আপনি ছবি তোলার ঝোঁকে বাসার খুব কাছাকাছি গেছেন কিনা, বা গাছে চড়ে ছবি নিয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অমন যদি করে থাকেন, তাহলে আপনার সংকেত পেয়ে আরও অনেকে করবে এবং পাখি বাসা ছেড়ে চলে যাবে। তাতে ডিম বা বাচ্চা সারভাইভ করবেনা। দ্বিতীয়ত, আপনার লম্বা জুমের কাছে পথনির্দেশ পেয়ে অনেক শিকারি পাখি সেই বাসা বা তার ভেতরে থাকা মা-বাবা বা বাচ্চাদের খোঁজ পেয়ে যেতে পারে।এখানে কিন্তু আমাদের দুটি জীপের সবাই ছবি নিলাম। কারণ বাসাটা একদম রাস্তার ধারে পুরোপুরি খোলা জায়গায়। কাউকে নির্দেশ দেবার প্রয়োজন নেই সকলেই সটান দেখতে পাচ্ছেন। বাসার অকুপ্যান্টপদের ক্ষতি হবার থাকলে এমনি হবে আমাদের ছবি তোলার জন্য নয়। তাছাড়া কোনও শিকারি পাখি এলে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার(পিএফসি) কর্তা গিন্নি প্রবলভাবে তাকে তাড়িয়ে এলাকাছাড়া করা পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। আর ছোট পশুর কাছেও বিপদ নেই, কারণ একটি ঝুলন্ত ডালে করা হয়েছে বাসাটি। একমাত্র সাপ যদি কিছু করতে পারে। তবে সে তো আমাদের ক্যামেরা দেখে কিছু করবেনা।
এটি মেল পিএফসি। কিন্তু এটি রুফাস মর্ফড, মানে কমলা রঙের, সাদা নয়। এবার মাইগ্রেশনে রুফাস মর্ফড-ই বেশি। আমি এর আগে পিএফসি পুরুষকে সাদাই দেখেছি অধিকাংশ জায়গায়। ছবিটা নেবার অন্য কারণ হচ্ছে, এমন শান্তভাবে পিএফসিকে পাওয়া কখনওই যায়না। তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এডাল ওডাল নেচে বেড়ায়। এবার তাকে ক্যামেরায় ধরতে হলে অবেক বাড়াতে হবে শাটার স্পীড। সঙ্গে সঙ্গে আইএসও-কেও সেই পরিমাণ বাড়াতে হবে। আর আমার ক্যামেরায় ১৬০০ এর বেশি হলেই ফেটে চুরমার হয়ে যাবে ছবি। তাই এপাখি অধরাই ছিল আমার। এখন সে বসে আছে। তার সুন্দর লেজটি পুরো বাঁক নিয়ে ঝুলছে হাওয়ায়। তবে গরমে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে মুখ হাঁ করে কোনও রকমে কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করছে।
এর পরের ছবি আবার ইন্ডিয়ান পিট্টার। সব রকম রঙই দেখা যাচ্ছে। তবে বেশ দূরে ছিল, তাই এর চেয়ে আর বড় করা সম্ভব নয়।শেষ ছবিটি হট্টিমার বাচ্চার। সম্ভবত গাইডই স্পট করেছিল। আমি জীবনে প্রথম
দেখলাম। এবারে হট্টিমার ডিমে তা দেওয়ার ছবিও পেয়েছি। এই নিয়ে কিছু কথা বলি।
অনেক ভ্রান্ত রটনা আছে এ পাখিকে নিয়ে। এমন কথা গ্রামেগঞ্জে বা অনেক লোককথা
থেকে ছড়িয়ে বিদগ্ধ মানুষও বিশ্বাস করেন যে হট্টিমা বা হট্টিটি পাখি আকাশের
দিকে ঠ্যাং তুলে চিত হয়ে ঘুমোয়। খুবই ভুল কথা। আবার সে যে ঠ্যাং ওপর দিকে
তোলেনা তাও নয়। আসলে এই পাখি মাঠে চরা পাখি। আজকাল মাঠ আর কই, তাই জঙ্গল
ছাড়া এদের ঠাঁই নেই কোথাও। তবে কোথাও যদি ডিম বা বাচ্চা মাঠে আক্রান্ত
হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়, তখন এদের পালানোর আর কোনও উপায় নেই। তাই উড়ন্ত
বাজ না ঈগল দেখলে এরা বাসার কাছে মাটিতে চিত হয়ে এদের বিশাল লম্বা ও
নখযুক্ত পাদুটি ওপরে তুলে রাখে, যাতে ওপর থেকে নেমে আসা শত্রু ওই ‘বল্লম’
দেখে আর নেমে আসার সাহস না পায়। তবে তাকে খুব যে কাজ হয়, তা নয়। কেবল
কয়েকটি ছোট শিকারি পাখি ফিরে যায়।
আজ সারা দিন মায়ামৃগ নয়, ‘মায়া-বাঘ’ খুঁজতে চষে ফেলা হয়েছে জঙ্গলের আনাচ কানাচ। কিন্তু ‘সবই মায়া’।
নীচে তিনটে বাচ্চা নিয়ে মা হট্টিমার ছবি আর একবার। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।
ইংরিজি কথা ‘রেজিলিয়েন্স’ কথাটা
বোম্বেতে(মুম্বাইতে) খুব চালু। কুখ্যাত বোম্বে ব্লাস্ট এর পরের দিন বা তার পরের
দিন সেই জাভেরি বাজারেই কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। আরে বাবা বম তো আর রোজ ফাটবেনা।
স্টক এক্সচেঞ্জে হামলার পরেও সেই একই কথা। তাজ বেঙ্গলের ঘটনার পরেও খবরের কাগজে হেড লাইন, ‘মুবাই ইজ রেজিলিয়েন্ট’। আসলে ও সব
বকওয়াস। বাঙালি যতটা সেন্টিমেন্টাল, মুম্বাইকর
ততটাই কমার্শিয়াল। আরে ভাই পেট তো চালাতে হবে, বসে বসে
কাঁদলে হবে?
আমারও মন খারাপ ছিল, এখনও আছে। তবে মনে আশাও আছে
কিছু একটা সুরাহা হওয়ার। যাকে তিন দিন আগে চিনতামনা তার জন্যও চিন্তা হচ্ছে বাঙালি
বলেই। বাঙালি বলেই ইনবক্সে বেশ কয়েকটা অফার এসেছে, তাঁরা কিছু
করতে পারবেন হয়ত, এসব বলে। আমার কাজ যোগাযোগ
করিয়ে দেওয়া। যদি কিছু করা যায়। অনুপমরা ‘ব্লাড মেট’ তৈরি করেছে
আমি ‘গোস্ট-মেট’, উদ্দেশ্য
একই। জনসেবা। যতটুকু পারি, যা দিয়ে পারি।
সেদিন হট্টিমা পাখির বাচ্চা দেখতে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল। কিন্তু আসলে আলো
পড়তে আরও কিছুটা বাকি ছিল। কয়েকটি প্রাণীকে দেখিয়ে নিই। প্রথমে দেখাই কুমির। এটি
একটি জলাশয়ের মাঝে দ্বীপের মতো জায়গায় রোদ পোয়াচ্ছিল। এই মওকায় খানিক জ্ঞানও ঝেড়ে
দিই। আচ্ছা কুমির তো বুঝলাম, বলুন তো এটা ‘অ্যালিগেটর’ না ‘ক্রোকোডাইল’? এই কিছুদিন
আগে যখন সুন্দরবন গেছিলাম, বিশাল বিশাল কুমির দেখেছিলাম।
তা আমাদের যিনি গাইড ছিলেন, সে ট্র্যাভেলগে তাঁর নাম লিখেছি, এতদিনে ভুলে
গেছি। তিনি খুব জ্ঞানী মানুষ, মানে নিজে তাই ভাবেন। আমাকে
গম্ভীর মুখে বললেন, ক্রোকোডাইল আর অ্যালিগেটরের
তফাত হলো, ক্রোকোডাইল শুধু ওপরের পাটির
চোয়াল ফাঁক করতে পারে, আর অ্যালিগেটর দুটো চোয়ালই ফাঁক
করতে পারে। ভদ্রলোক এত কম্যান্ডিং টোনে কথা বলেন, যে আমি চেপে
গেলাম। তা দেখুন তো দুই চোয়াল ফাঁক করা এটি কি অ্যালিগেটর? না। এটি
পুরোদস্তুর ক্রোকোডাইল। অ্যালিগেটর অনেক গাঢ় রঙের হয়। আর সুন্দরনের বিশাল
কুমিরগুলিও ক্রোকোডাইল। অ্যালিগেটর নোনা জলের ধারে কাছে যাবেনা কোনওদিন।
কথায় বলে জলে কুমির-ডাঙায় বাঘ। কথাটি অবশ্য সুন্দরবন এলাকার জন্যই প্রযোজ্য।
কিন্তু এখানে তাড়োবায় কী হবে? এত বাঘ এখানে, আর আমার
সঙ্গীরা বাঘ না পেয়ে মুষড়ে পড়েছেন অনেকেই। সব চেয়ে মুষড়ে পড়েছে দীপঙ্কর, যেন বাঘ
দেখাতে না পারলে সব দোষ ওরই। এদিকে আমিই হচ্ছি দলে একমাত্র লোক, যে বাঘসফরে
যায় না কখনই। আমি পাখি পেয়েই খুশি। আরও কিছু হলে ভাল হত। তবে হতচ্ছাড়া ড্রাইভার তা
হতে দিলনা।
চলুন একটা ঘুঘু দেখুন। এটা কলকাতাতেও পাবেন, তবে কম। আগে ‘ইন্ডিয়ান রিঙ
ডাভ’ বলা হত, এখন বলে ‘ইউরেশিযান
কলারড ডাভ’। আমরাও তাই বলি, কর্তার
ইচ্ছেয় কর্ম। বাংলায় এর নাম ‘পর ঘুঘু’। গলায়
কলারের মত দাগ আছে দেখুন। ভাল পার্চে ছিল বলে নিলাম। ডানার রঙটাও খুলেছে। আমি ভাল
পোজিশনে চড়াই পেলেও ছবি নিই। সব পাখিই সুন্দর।
এর পর যাকে আনছি, সে পাখি নয়, পশু। তার নাম
‘বার্কিং ডীয়ার’ বা ইন্ডিয়ান
মুঁজ্জ্যাক(Indian muntjac) হিন্দীতে বলে ‘কাকর’। এদের
পুরুষগুলোর মাথার শিঙ আবার অনেকটা পর্যন্ত চামড়া দিয়ে মোড়া। একটা পেলে দেখাতাম।
ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। এই বার্কিং ডীয়ার, কুকুরের মত ‘ঘেউ’ করে, তবে ‘ঘেউ ঘেউ’ নয়। একবারই
ডাকে। বাঘের উপস্থিতে যে সব ডাক জানান দেয়, তার মধ্যে
আছে লঙ্গুর হনুমানের ডাক, কাকরের ডাক আর সম্বরের ডাক। তবে
বাংলা সিনেমা বা নাটকে যেমন হট্টিমার ডাককে নানা ভাবে ব্যবহার করা হয়(রায়বাবুও
করেছেন), নানা ধরণের অরণ্যভিত্তিক
উপন্যাসে, এই কাকরের ডাককে উল্লেখ করা
হয়েছে। আসলে জঙ্গলের রহস্যটাই এখন আর নেই আধুনিক জাঙ্গল ট্যুরিজমের দৌলতে। একসময়ের
‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ আর ‘রহস্যময়’ বাঘ এখন র্যাম্পে
হাঁটে কোমর দুলিয়ে। কী আর করা যাবে পয়সা তো আসছে। ‘ইট’স দা মানি
হানি’।
একটা ছবি দিলাম। কিছু বুঝছেন? এটা কিন্তু
৪০০ জুম পুরো খুলে তাই দিয়ে নেওয়া। তাহলে খালি চোখে কী দেখা গেল অনুধাবন করুন।
কিছু একটা আবছা মতন লাগছেনা?
আসুন পরের ছবিতে। - হুই জলার পাড়ে শুয়ে ঘুম দিচ্ছে এ এলাকার রঙবাজ। নাম তার ‘মটকাসুর’ আগে রঙবাজ
ছিল ‘গব্বর’, কিন্তু তাকে
সরায়নি কোনও ভীরু বা জয়। তার খবর নিয়েছে মটকাসুর। সেই এখন হিরো। অবশেষে দূরনীক্ষণ
যন্ত্রে ব্যাঘ্র ধরা পড়িল। জনগন আনন্দে দুই হস্ত উঠাইয়া ‘হরি হরি’ বলিয়া ‘নেত্য’ করিল।
চলুন আবার হবে।
Comments